জাহিদুর রহমান: ঝিনাইদহের ঐতিহাসিক নলডাঙ্গা রাজ প্রাসাদ এখন ফসলের মাঠ। কয়েক বছর ধরে এখানে চাষাবাদ হচ্ছে। ঐহিহাসিক এই স্থানটিতে দর্শনাথীদের এখন নেই কোন আনাগোনা। অথচ এখানে একসময় ছিল রাজ্য, রাজা আর রাজ্য রক্ষার জন্য সৈন্য সামন্ত বাহিনী।এখানে বসে একসময় রাজা রাজ্য পরিচালনা করতেন।সেই রাজ্যও নেই, রাজা-প্রজাও নেই। কালের স্বাক্ষী হয়ে দাঁড়িয়ে আছে কেবল আটটি মন্দির।
এই রাজ বংশের ইতিহাস-ঐতিহ্য বিলিন হয়ে গেছে সেই পাকিস্তান আমলেই।লোকমুখে এবং ইতিহাস থেকে জানা যায়, প্রায় পাঁচশত বছর আগে এই রাজ বংশের আদি পুরুষ ভট্রারায়ন ফরিদপুরের তেলিহাটি পরগনার অধীন ভবরাসুর গ্রামে বসবাস করতেন।তারই এক উত্তরাধীকারী সুরী বিঞ্চুদাস হাজরা নলডাঙ্গার রাজ বংশ প্রতিষ্ঠা করেন।তার পিতার নাম ছিল মাধব শুভরাজ খান। বৃদ্ধ বয়সে বিঞ্চুদাস ধর্মের প্রতি বিশেষ অনুরাগী হয়ে সন্ন্যাসী হন এবং ফরিদপুরের ভবরাসুর হতে নলডাঙ্গার নিকট খড়াসিং গ্রামে চলে আসেন।বেগবতী নদীর তীরে এক জঙ্গলে তপস্যা শুরু করেন তিনি।
১৫৯০ সালে মোঘল সুবেদার মানসিংহ বঙ্গ বিজয়ের পর নৌকা যোগে বেগবতী নদী দিয়ে রাজধানী রাজমহলে যাচ্ছিলেন।তার সৈন্যরা পথিমধ্যে রসদ সংগ্রহের জন্য অনুসন্ধানে বের হয়ে বিঞ্চদাস সনাœসীকে তপস্যারত অবস্থায় দেখতে পান।এসময় বিঞ্চুদাস সৈন্যদের খুব দ্রুত রসদ সংগ্রহ করে দেন। এতে সুবেদার মানসিংহ খুশি হয়ে সন্যাসীকে পার্শ¦তর্বী পাঁচটি গ্রাম দান করে যান।এই গ্রামগুলির সমন্বয়ে প্রথমে হাজরাহাটি জমিদারী এবং ক্রমান্বয়ে তা নলডাঙ্গা রাজ্য হিসাবে প্রতিষ্ঠিত হয়। তখন এই এলাকাটি নল নটায় পরিপুর্ন ছিল তাই স্থানটি নলডাঙ্গা নামেই অভিহিত হয়।
এরপর প্রায় তিনশত বছর এবংশের বিভিন্ন শাসক বিভিন্ন সময়ে এই রাজ বংশ শাসন করেন এবং বিভিন্ন শাসক বিভিন্ন সময়ে বিলুপ্তপ্রায় মন্দিরগুলো প্রতিষ্ঠা করেন। এরপর ১৮৭০ সালে রাজা ইন্দু ভূষন যক্ষা রোগে মারা গেলে তার নাবালক দত্তক পুত্র রাজা বাহাদুর প্রথম ভূষণ দেবরায় রাজ্যের দ্বায়িত্ব ভার গ্রহন করেন। এবং তিনিই প্রতিষ্ঠা করেন আজকের এই বিলুপ্তপ্রায় কয়েকটি মন্দির যা কালের সাক্ষী হিসাবে মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে আছে বেগবতী নদীর তীরে।
প্রকৃতপক্ষে রাজা বাহাদুর প্রথম ভূষণ দেবরায় ছিলেন বর্তমান ঝিনাইদহ জেলার কুমড়াবাড়িয়া গ্রামের গুরুগোবিন্দ ঘোষালের কনিষ্ট পুত্র।রাজা ইন্দু ভূষন মারা যাওয়ার দীর্ঘ নয় বছর পর ১৮৭৯ সালে পূর্ণ জমিদারীর ভার গ্রহণ করেন রাজা বাহাদুর প্রথম ভূষণ দেবরায়।তিনিই ১৮৮২সালে রাজবাড়ির নিকট আজকের নলডাঙ্গা ভূষণ হাই স্কুলটি প্রতিষ্ঠা করেন।যেটি এখন কালীগঞ্জের প্রাণ কেন্দ্রে অবস্থিত।
১৯৫৫ সালে এক সরকারি আদেশে অন্যান্য জমিদারীর মতো এই জমিদারীও সরকারের নিয়ন্ত্রণে চলে যায়। পরবর্তীতে মন্দিরের আর কোন সংস্কার কাজ হয়নি। এরপর স্থানীয় লোকজন নিজেদের টাকায় ১৬৫৬ সালে প্রতিষ্ঠিত শ্রী শ্রী সিদ্ধেশরী মায়ের মন্দিরসহ কালীমাতা মন্দির, লক্ষ্মী মন্দির, তারা মন্দির, দ্বিতল বিশিষ্ট বিঞ্চু মন্দিরের সংস্কার কাজ শেষ করে।তারপর থেকে এখন পর্যন্ত আর কোন সংস্কারের উদ্দোগ নেওয়া হয়নি।
এ ব্যাপারে নলডাঙ্গা ইউপি চেয়ারম্যান রবিউল ইসলাম রবি জানান, স্থানটিতে আগে হাজার হাজার লোকের সমাগম ঘটতো। সংস্কার আর যাতায়াতের সুব্যাবস্থা না থাকায় এখন দর্শনার্থীরা আসছেন না।দক্ষিণ পাশে বেগবতি নদীর উপর একটি ব্রিজ নির্মাণ হলে পার্শবর্তী কয়েকটি গ্রামের লোকজন সহজেই আসতে পারতো। দেশের প্রত্নতত্ব্ বিভাগ অতি প্রাচীন এই ইতিহাস আর ঐতিহ্য রক্ষায় উদ্যেগি হলে এটি হতে পারতো এক অমুল্য সম্পদ।