ঈশ্বরদী (পাবনা) থেকে স্বপন কুমার কুন্ডু: লিচু গাছের প্রতিটি ডালে থোকায় থোকায় লিচু পেঁকে টকটকে লাল রঙ ধারণ করতে শুরু করেছে। লিচুর রাজধানী বলে খ্যাত ঈশ্বরদীর লিচু হাটে ইতিমধ্যেই দেশের বিভিন্ন এলাকা হতে আগত পাইকারের পদচারণায় সরগরম হয়ে উঠেছে।
লিচুর মুকুল ও গুটি দেখে আগে থেকেই ধারণা করা হয়েছিল এবারে লিচুর ভালো ফলন হবে। হয়েছেও তাই। বড় কোনো প্রাকৃতিক দুর্যোগ বা খরা পরিস্থিতি মোকাবেলা করতে হয়নি চাষিদের। চৈত্র ও বৈশাখ মাসে প্রায়ই বৃষ্টি হওয়ায় লিচু গাছে তেমনভাবে পানিও দিতে হয়নি। গতবারের তুলনায় এবারে সম্প্রসারিত হয়ে ২ হাজার ৫০০ হেক্টর জমিতে লিচুর চাষ হয়েছে। ইতিমধ্যে বাজারে দেশি মোজাফ্ফর (আঁটি) জাতের লিচু বাজারে উঠতে শুরু করেছে। এই লিচু ২০০০-২৫০০ টাকা হাজার দরে বিক্রি হচ্ছে। তবে এই লিচুর পরিমাণ কম। এখানে বোম্বাই লিচুই বেশি পরিমানে ফলন হয়। সবকিছু মিলিয়ে এবারে ঈশ্বরদীতে ৩০০ কোটি টাকার লিচু বিক্রি হবে বলে প্রাক প্রাক্কলন করা হয়েছে।
লিচু চাষিরা জানান, ঈশ্বরদীতে সাধারণত তিন প্রজাতির লিচুর বেশি ফলন হয়ে থাকে। এগুলো হলো মোজাফ্ফর বা দেশি (আঁটি) লিচু, বোম্বাই লিচু ও চায়না-৩ লিচু। এছাড়াও বিভিন্ন বাগানে কদমী লিচু, কাঁঠালী লিচু, বেদানা লিচু ও চায়না এক, দুই, তিন লিচুর চাষ হচ্ছে। তিন প্রজাতির লিচুর মধ্যে সবার আগে মোজাফ্ফর বা দেশি লিচু পেঁকে থাকে। তাই চাষি ও ব্যবসায়ীরা বাজারে সবার আগে দেশি লিচু নিয়ে আসেন। তিন প্রজাতির লিচুর মধ্যে চাষিরা বোম্বাই ও চায়না-৩ লিচু বেশি দামে বাজারে বিক্রি করেন। কারণ বোম্বাই প্রজাতির লিচু আকারে বেশ বড় এবং খেতেও বেশ মিষ্টি। আর চায়না লিচু আকারে দেশি লিচুর মতো হলেও খেতে খুবই সুস্বাদু এবং এর আঁটি ছোট হয়। এবছর অনাবৃষ্টি ও খরায় লিচু নষ্ট না হওয়ায় বাগানের গাছগুলোতে যে পরিমাণ লিচু পেঁকেছে তা অন্যান্য বছরের তুলনায় অনেক বেশি।
কৃষি অফিস সুত্রে জানা যায়, ঈশ্বরদীর ছলিমপুর, সাহাপুর ও দাশুড়িয়া ইউনিয়নে সবচেয়ে বেশি লিচুর আবাদ হয়েছে। প্রতিটি বাড়িতেই রয়েছে লিচুর গাছ। পৌরসভা ও ৭টি ইউনিয়নের প্রতিটি গ্রামে বাণিজ্যিক ভিত্তিতে ব্যাপক হারে লিচুর চাষ হচ্ছে । আগে যেসব জমিতে বেগুন, হলুদ, ধনিয়া, আম এবং কাঁঠাল হতো এখন সেখানে হয়েছে লিচু বাগান। লিচু চাষে লাভ বেশি হওয়ায় বিগত ১৫-২০ বছর যাবত চাষীরা লিচু চাষের দিকে বেশি ঝুঁকে পড়েছেন। চাষিরা জানান, নবান্নের উৎসবের মতো লিচু মৌসুমে চাষিদের মধ্যে দেখা দেয় আনন্দ। মনের আনন্দে সারা রাত জেগে লিচু গাছ পাহারা দেন তারা। লিচুর এই মৌসুমে আত্মীয়-স্বজনেরাও দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে ঈশ্বরদীতে বেড়াতে আসেন। যেন ঈদ বা বিয়ে উৎসবের মতো।
চাষিরা আরো জানান, গাছে গুটি দেখা দিলেই দেশের বিভিন্ন এলাকা হতে ছুটে আসে পাইকারী ব্যবসায়ীরা। গুটি দেখে তারা বাগান মালিকদের কাছ থেকে আগাম গাছ কিনে নেয়। একেকটি গাছ বিক্রি হয় ৫ থেকে ২০ হাজার টাকা পর্যন্ত। গাছ বিক্রির পর ফল বড় হওয়া পর্যন্ত গাছের পরিচর্যা করে থাকেন ওই পাইকাররা। এক গাছই ধাপে ধাপে ৩ বার পর্যন্তও বিক্রি হয়।
ঈশ্বরদীর জয়নগর শিমুলতলা, আওতাপাড়া, বাঁশেরবাধা, সাহাপুর, দাশুড়িয়া, ভাড়ইমারী আনন্দ বাজারসহ বিভিন্ন স্থানে জমে উঠেছে পাইকারী লিচুর হাট। প্রতিদিন কাক ডাকা ভোরে বসছে লিচুর বিশাল হাট। এসব হাট ও সরাসরি লিচু বাগান থেকে পূর্ণ মৌসুমে প্রতিদিন গড়ে ১০০ ট্রাক লিচু রাজধানী ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে চালান হয়। লিচু চাষি আব্দুল বারী জানান, এখন হাটে প্রতিদিন লিচুর আমদানী বাড়ছে।
লিচু ব্যবসায়ীরা জানান, সোমবার ঈশ্বরদীতে প্রতি হাজার দেশী (আঁটি) লিচু বিক্রি হয়েছে দুই হাজার থেকে আড়াই হাজার টাকা পর্যন্ত। বোম্বাই লিচু বাজারে আসলে দাম আরো বাড়বে বলে কৃষক ও ব্যাবসায়ীরা জানিয়েছেন। ঢাকার পাইকারী ব্যবসায়ী আফতাব জানান, তারা প্রতিদিন ঈশ্বরদীর বিভিন্ন হাট ও লিচু বাগান থেকে লিচু কিনে ঢাকার বিভিন্ন পাইকারী আড়তে বিক্রি করছেন। তিনি জানান, ঈশ্বরদীর এই লিচু রাজধানী ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন বাজারে রাজশাহীর লিচু বলে বিক্রি হয়।
কৃষি কর্মকর্তা কৃষিবিদ খুরশিদ আলম জানান, বাংলাদেশের মধ্যে সবচেয়ে বেশি লিচুর গাছ রয়েছে ঈশ্বরদীতে। দিনাজপুরেও ব্যাপক হারে লিচু চাষ হচ্ছে। তবে সেখানে চায়না-৩ লিচুর বেশি আবাদ হয়। এখানে রেকর্ড পরিমাণ জমিতে ২ হাজার ৫’শ হেক্টর জমিতে বাণিজ্যিক হারে লিচুর আবাদ হয়েছে। প্রতিটি লিচু গাছে ৫ হাজার থেকে শুরু করে ৩০ হাজার পর্যন্ত লিচু ফলে। এখন পর্যন্ত বড় ধরণের কোনো প্রাকৃতিক দুর্যোগ বা খরা পরিস্থিতি মোকবেলা না করার কারণে এবারে ব্যাপক লিচু উৎপাদন হয়েছে বলে তিনি জানান। যে কারণে এবছর ঈশ্বরদীতে তিন’শ কোটি টাকার লিচু বিক্রি হবে বলে কৃষি অফিস আশা করছে।