লাশ হয়ে ফিরলেন ৩ জেলে, নিখোঁজদের জন্য অনবরত বিলাপ

প্রতিনিধি, বাগেরহাট: বঙ্গোপসাগরে ঝড়ের কবলে পড়ে মাছ ধরার নৌকা ও ট্রলারডুবিতে নিখোঁজ জেলেদের মধ্যে তিনজনের মৃতদেহ উদ্ধার হয়েছে। গতকাল (মঙ্গলবার) বিকেল ৩টার দিকে সুন্দরবনের দুবলা জেলেপল্লীর আলোরকোল ও মরারচর এলাকা থেকে তাদের মৃতদেহ উদ্ধার করা হয়। মৃতের সংখ্যা আরো বাড়তে পারে বলে আশঙ্কা করছেন সংশ্লিষ্টরা।

দুবলা ফিশারম্যান গ্রুপের সাংগঠনিক সম্পাদক শাহানূর রহমান শামীম জানান, বঙ্গোপসাগর উপকূলের আলোরকোলের লাইট হাউজ এলাকা থেকে দুটি এবং মরার চরের কাছ থেকে একটি মৃতদেহ উদ্ধার করা হয়। তবে তাৎক্ষণিকভাবে তাদের পরিচয় জানা যায়নি। গত ২০ সেপ্টেম্বর সাগরে ঝড়ের কবলে পড়ে ট্রলার ও নৌকাডুবির পর এরা নিখোঁজ ছিলেন। এখনো অনেক জেলে নিখোঁজ রয়েছেন বলে জানান তিনি।

মঙ্গলবারেও বাগেরহাট দড়াটানা নদীর কেবি ট্রলারঘাটে নিখোঁজ জেলেদের স্বজনদের আহাজারি করতে দেখা গেছে। একটি ট্রলার ঘাটে ভিড়লেই তারা ছুটে যাচ্ছেন। ফিরে আসা জেলেদের জড়িয়ে কেউ কেউ কাদঁছেন।  কেবি মৎস্য আড়তের ট্রলার মালিক-শ্রমিক, আড়তদার, মহাজন সকলকেই উদ্বিগ্ন দেখা গেছে।

উপকূলীয় মৎস্যজীবী সমিতির সভাপতি শেখ ইদ্রিস আলী মঙ্গলবার দুপুরে বলেন, এ পর্যন্ত ৩০ জনের মতো ফিরে এসেছে। কেউ হাসপাতালে আবার কেউ ক্লিনিকে ভর্তি হয়ে চিকিৎসা নিয়ে বাড়ি ফিরছেন।

বাগেরহাট কেবি মৎস্য আড়তের ব্যবসায়ী আব্দুস সালাম হাওলাদারের একটি ট্রলারের নিখোঁজ ১৩ জনের মধ্যে নয়জন জীবিত উদ্ধার হয়েছেন। এদের মধ্যে রয়েছেন মোরেলগঞ্জের সৈয়দ মাঝি, কচুয়ার বগা গ্রামের আলাল, শহিদুল, হানিফ, ফরিদ, সদরের পালপাড়ার ইসমাইল, বেল্লাল, জোহর ও পাথরঘাটার মালেক। এফবি সাগর-২ নামের ওই ট্রলারের নিখোঁজ চারজন হলেন সদরের ইব্রাহিম, সিদ্দিক মিস্ত্রী, বেতিবুনিয়া গ্রামের ওহাব ও সাখাওয়াত।

bay of bengal fishing boats casizedস্থানীয় জেলেরা জানান, এখনো বাগেরহাটের প্রায় ৪০ থেকে ৫০ জেলের কোনো খোঁজ পাওয়া যাচ্ছে না। এদের অধিকাংশের বাড়ি বাগেরহাটের কচুয়া উপজেলার বগা গ্রামে।

নিখোঁজ জেলেদের খোঁজ নিতে রাতে কেবি ঘাটে আসা কচুয়ার বগা গ্রামের ইসমাইল বাওয়ালী (৪৩) জানান, বগা গ্রামের প্রায় তিনশ জেলে পরিবারের বাস। তারা সবাই সমুদ্রে মাছ ধরে জীবন নির্বাহ করে। এই এলাকার জেলেদের নিয়ে সাগরে মাছ ধরে যাওয়া এফবি শাহজাহান, এফবি আউয়াল, এফবি রুপক ও এফবি সজল নামে চারটি ট্রলারের ৬০ জেলের মধ্যে ১৩ জনের সন্ধান পাওয়া গেলেও এখনো নিখোঁজ রয়েছে অন্তত ৪৭ জন।

বাগেরহাট কেবি মৎস্য অবতরণ কেন্দ্রে ফিরে আসা জেলেরা জানান, ডুবে যাওয়া ট্রলারের অনেক জেলে সাগরে ভেসে ও অন্য ট্রলারের মাধ্যমে কূলে আসতে সক্ষম হলেও বহু জেলে কোনো খোঁজ পাওয়া যাচ্ছে না।

শনিবার ভোর রাতে বঙ্গোপসাগরের সুন্দরবন উপকূলের দুবলার চর ও সংলগ্ন এলাকায় ঝড়ের কবলে পড়ে ট্রলারডুবিতে নিখোঁজ বাগেরহাটসহ বিভিন্ন এলাকার অর্ধশত জেলের এখনো সন্ধান পাওয়া যায়নি। মঙ্গলবার দুপুর পর্যন্ত বরগুনা, পটুয়াখালী, চট্টগ্রাম, বাগেরহাট ও খুলনার প্রায় ২৫০ জেলে উদ্ধার হয়েছেন বলে বিভিন্ন সূত্রে জানা গেছে।

সাড়ে ৫ ঘণ্টা ভেসে থাকার পর উদ্ধার হলেন ইসমাইল

“তখন ভাবতে পারিনি জীবিত ফিরতে পারবো, শুধু বাচাঁও বাচাঁও বলে চিৎকার করছিলাম। আল্লাহতায়ালা আমাকে বাঁচিয়ে রেখেছেন। অনেক জেলেকে সাগরে ভাসতে দেখেছি, তাদের কি হয়েছে জানি না’।

গভীর সাগরে ঝড়ের কবলে পড়ে সাড়ে পাঁচ ঘন্টা ভেসে থাকার পর জীবিত উদ্ধার হয়ে ফিরে আসা জেলে ইসমাইল এভাবেই জানালেন তার টিকে থাকার কথা।

সোমবার রাত ৯টার দিকে উদ্ধার হওয়া অন্য জেলেদের সঙ্গে বাগেরহাট কেবি মৎস্য আড়তে আসেন ইসমাইল। সেখানে তার সাথে এ প্রতিবেদকের কথা হয়। দু:সহ স্মৃতির কথা জানাতে গিয়ে বলেন, সেদিন আবহাওয়া মোটামুটি ভালোই ছিল। ঝড়ের কোনো পূর্বাভাস ছিল না। শনিবার রাত আনুমানিক ৪টার দিকে সুন্দরবন উপকূল থেকে প্রায় দেড়শ কিলোমিটার দূরে মাছ ধরছিলেন তারা। হঠাৎ সাগরে ঝড় শুরু হয়। ঝড়ের তোড়ে জেলে বহরে থাকা ৪০ থেকে ৫০টি ট্রলারের অনেকগুলো ডুবে যায়। ট্রলার ডুবে গেলে তিনি সাগরে পড়ে যান।

ভোর ৫টা থেকে সকাল সাড়ে ১০টা পর্যন্ত গভীর সাগরের উথাল-পাথাল ঢেউয়ে ভাসতে থাকেন। পরে অন্য জেলেরা তাকে উদ্ধার করে। তবে এখনো তার চার সহকর্মীকে খুজেঁ পাওয়া যায়নি।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.