সুন্দরবন দুর্ঘটনায় অভ্যন্তরীণ নৌ বাণিজ্যে বিপর্যয়, শ্রমিকদের দুর্ভোগ

রবিউল হাসান রবিন: পিরোজপুরের কাউখালীর গাবখান নদী থেকে শুরু হয়ে সুন্দরবনের পূর্ব চাঁদপাই রেঞ্জের শেলা নদীর প্রবেশমুখ পর্যন্ত নদীতীরে মালবোঝাই জাহাজের মিছিল। সবার গন্তব্য সুন্দরবনের ভেতর দিয়ে শেলা নদী হয়ে মংলা বন্দর। মালবাহী জাহাজের মিছিল এখন আন্তর্জাতিক নৌচ্যানেল গাবখানে এসে আটকে যাচ্ছে। কারণ সুন্দরবনের শেলা নদীতে তেলবাহী জাহাজ ডুবির ঘটনায় ২৩ দিন ধরে ওই নদীর ভেতর দিয়ে নৌযান চলাচল বন্ধ। এর ফলে ঝালকাঠির সুগন্ধা ও গাবখান, কাউখালীর সন্ধ্যা, কঁচা, মঠবাড়িয়ার বলেশ্বর, শরনখোলার বগিরখাল, সুপতি (মড়াপোলা) নদ-নদীতে অন্তত ৫০০ মালবোঝাই জাহাজ নোঙর করে রয়েছে। এর মধ্যে কাউখালীতে রয়েছে শতাধিক জাহাজ।

বিকল্প পথে বঙ্গোপসাগর হয়ে মংলা নৌবন্দরে যাওয়া সম্ভব। তাতে সময় এবং নৌপথের খরচ কিছুটা বাড়বে। বিকল্প সুযোগ থাকার পরও দীর্ঘ ২২ দিন বিভিন্ন নদীতে নোঙর করে আছে জাহাজগুলো। কেন বিকল্প পথে জাহাজগুলো মংলা যাচ্ছে না ? এমন প্রশ্নে জাহাজের চালকদের সোজাসাপ্টা উত্তর- লবণে ভয়, তাই শেলা হয়ে যাই। অর্থাৎ বঙ্গোপসাগর ধরে মংলা পৌছতে হলে লোনাপানির দীর্ঘ পথ পাড়ি দিতে হবে। কিন্তু শেলা নদী হয়ে চলাচলকারী ওই জাহাগুলো লোনাপানিসহিঞ্চু নয়, এতে জাহাজ ক্ষতিগ্রস্ত হবে। তাই তুলনামূলক কম লবণাক্ত শেলা নদী হয়ে জাহাজগুলো মংলা পৌঁছতে চাইছে।

কাউখালীতে নোঙর করে রাখা নৌযান।
কাউখালীতে নোঙর করে রাখা নৌযান।

দুর্ভোগে জাহাজের শ্রমিকরা

শেলা নদীর দুই প্রান্তে আটকে থাকার কারণে এসব জাহাজের মাস্টার ও শ্রমিকরা পড়েছেন দুর্ভোগের মধ্যে। মালিকপক্ষ বেশি খরচের ভয়ে তাদের খোঁজখবর নিচ্ছে না। কেউ অসুস্থ হলেও চিকিৎসা নিতে পারছেন না। অনেকের খরচর টাকা ফুরিয়ে গেছে। এমনকি অচেনা অপরিচিতদের কাছ থেকে অর্থ পাওয়ার অনিশ্চয়তার জন্য স্থানীয় ব্যবসায়ীরা তাদের কাছে খাদ্যদ্রব্যসহ অন্যান্য প্রয়োজনীয় মালামাল বাকিতে বিক্রি করতেও চাচ্ছে না। এক কথায় মানবেতর জীবনযাপন করতে হচ্ছে তাদের। মালিকরা বলছেন, মালামাল খালাসের পর ভাড়ার টাকা সংগ্রহ করে সাধারণত জাহাজের স্টাফদের বেতন দেওয়া হয়। মাল খালাস করতে না পারায় টাকা পাওয়া যাচ্ছে না, তাই  স্টাফদের বেতন বন্ধ।

কাউখালীর শহরের লঞ্চঘাট এলাকা হতে সন্ধ্যা নদীর আমড়াজুড়ি ফেরীঘাট পর্যন্ত প্রায় দেড় কিলোমিটার এলাকাজুড়ে শতাধিক পণ্যবাহী জাহাজ নোঙর করে অপেক্ষা করছে। ফলে জাহাজের মালামাল মংলা বন্দরে খালাস করা যাচ্ছে না। এসব জাহাজে সিমেন্ট, ক্লিংকার, বালু, ফ্লাইএ্যাশ ও চুনাপাথরসহ বিভিন্ন মালামাল রয়েছে। আবার কিছু খালি জাহাজও রয়েছে, যা ভারতের উদ্দেশে যাবে সিমেন্ট তৈরির কাঁচামাল (ফ্লাইঅ্যাশ) আনতে। পণ্য বোঝাই জাহাজ যাবে মংলা, নওয়াপাড়া, খুলনা, চট্টগ্রাম, নারায়ণগঞ্জসহ দেশের বিভিন্ন এলাকায়।

কাউখালীর সন্ধ্যা নদীতে কুমিয়ান গ্রামে নোঙর করা জাহাজ ‘এমভি জালাল গিয়াস উদ্দীন’ এর মাস্টার মো. শহিদুল ইসলাম জানান তিনি সুনামগঞ্জের ছাতক থেকে সুপার ক্রিট সিমেন্ট নিয়ে এসেছেন। যশোরের নওয়াপাড়া যাবার জন্য তিনি সন্ধ্যা নদীতে ১২ ডিসেম্বর থেকে অপেক্ষা করছেন। শেলা নদী বন্ধ থাকায় তার জাহাজের মত শত শত জাহাজ সন্ধ্যা, বলেশ্বর, কঁচা, সুগন্ধা নদীতে নোঙর করে রয়েছে। প্রাণ গ্রুপের খাদ্য পরিবহনকারী ‘মোহনপুর-১’ জাহাজে থাকা ডেলিভারিম্যান মো. শহিদুল্লাহ জানান, তিনি ১৬ ডিসেম্বর থেকে কুমিয়ানা গ্রামের সন্ধ্যা নদীতে অবস্থান করছেন। তাদের জাহাজটি খুলনার ফুলতলার উদ্দেশ্যে নরসিংদীর ঘোড়াশাল থেকে ১৩ ডিসেম্বর ছেড়ে আসে।

এদিকে জাহাজের রসদ ফুরিয়ে যাওয়ায় চরম বিপাকে পড়েছে জাহাজগুলোতে থাকা কয়েক হাজার কর্মচারী। তারা জানান, ৯ ডিসেম্বরের পর থেকেই তারা পিরোজপুর, ঝালকাঠি ও বাগেরহাটের বিভিন্ন  নদীতে নোঙর করে রয়েছেন। ঘটনার পর তারা নদীতেই অবস্থান করায় তাদের সংগ্রহে থাকা খাবার ও টাকা-পয়সা ফুরিয়ে গেছে। অন্যদিকে মালিকপক্ষও তাদের কোনও অর্থ সরবরাহ করছে না। মাল খালাস না হওয়া পর্যন্ত তাদের টাকা-পয়সা পাওয়ার সম্ভাবনা নেই।

জাহাজের কর্মচারীরা জানান, জাহাজের আকার অনুসারে প্রত্যেক জাহাজে ৯-১৫ জন করে কর্মচারী রয়েছে। তারা চরম অসুবিধার মধ্যে দিন কাটাচ্ছেন। কাউখালীর কুমিয়ান গ্রামের সন্ধ্যা নদীতে গিয়ে ৬০টিরও অধিক বিভিন্ন আকারের জাহাজ নোঙর করা অবস্থায় দেখা গেছে। ‘এমভি দেওয়ান-১’ এর সুকানি মো. শাহাদাৎ হোসেন জানান, তাদের কাছে চলার মতো কোন টাকা নেই। যা ছিল তা এতদিনে ফুরিয়ে গেছে।

এদিকে জাহাজে থাকা বিভিন্ন পর্যায়ের কর্মচারীরা সরকারের কাছে দাবি করেছেন, যাতে অতি দ্রুত শেলা নদীর সমস্যা সমাধান করে জাহাজে কর্মরত হাজার হাজার শ্রমিককে চরম ভোগান্তি থেকে সরকার রক্ষা করে। অন্যথায় তারা কঠোর আন্দোলনে নামবেন বলে জানিয়েছেন ‘এমভি মেট্রোসেম-২’ এর চালক রাশেদুল ইসলাম। তিনি একজন জাহাজ শ্রমিক নেতা। তার দাবি রাজনৈতিক নেতারা শেলা নদী নিয়ে রাজনীতি করছেন এবং তাদের সীমাহীন ভোগান্তিতে ফেলেছেন।

সংকটে শিল্প

দীর্ঘ ২২ দিন ধরে মংলার নৌবন্দরের অভ্যন্তরীণ রুটে পণ্য পরিবহন বন্ধ থাকায় কোটি কোটি টাকার আর্থিক ক্ষতি হচ্ছে। কার্গো বার্জের অভাবে উৎপাদিত পণ্য বিক্রিও অর্ধেকে নেমে এসেছে। নৌযানের অভাবে মংলা-খুলনার শিল্পকারখানায় তীব্র কাঁচামাল সঙ্কট দেখা দিয়েছে। কাঁচামালের (ক্রুড লবণ) অভাবে খুলনাঞ্চলের লবণমিলগুলোও প্রায় বন্ধের উপক্রম বলে নৌ-শ্রমিক ও মালিকরা দাবি করেছেন। তারা বলছেন, শেলা নদীর দুই তীরে আটকে থাকা জাহাজগুলোর মাল খালাসের জন্য মানবিক কারণে শেলা নদী কয়েক দিন ব্যবহারের সুয়োগ তৈরি করে দেওয়া হোক। পাশাপাশি মংলা-ঘষিয়াখালী নৌপথের সঙ্গে থাকা সকল সংযোগ খাল কেটে মংলা-ঘষিয়াখালী নৌচ্যানেল পুনঃখননের দাবিও করেন তারা।

খুলনা নৌযান মালিক অ্যাসোসিয়েশনের মহাসচিব পল্টু খান জানান, খুলনার লবণমিলগুলোর জন্য বয়ে আনা ক্রুড (অপরিশোধিত) লবণ নিয়ে শেলার অপর প্রান্তে আটকে আছে বড় বড় বেশ কিছু সাম্পান। ওই সাম্পানগুলো  চট্টগ্রাম ও কক্সবাজার থেকে ছেড়ে এসে শেলার অপর প্রান্তে আটকে আছে। তাছাড়া নৌযান মালিকেরাও বসিয়ে বসিয়ে তাদের জাহাজের শ্রমিক কর্মচারীদের বেতন-ভাতা দিচ্ছে। ফলে লাখ লাখ টাকা আর্থিক ক্ষতির মুখে পড়েছেন নৌযান মালিকরা। নৌযান বন্ধ থাকায় বন্দর কেন্দ্রিক পণ্য পরিবহনে নৌযান চলাচল বন্ধ থাকায় কাঁচামাল সংকটে সঠিক উৎপাদন ব্যাহত হচ্ছে।

বিকল্প পথে মংলা

বাংলাদেশ অভ্যন্তরীণ নৌ-পরিবহন কর্তৃপক্ষ (বিআইডাব্লিউটিএ) কাউখালী প্রান্তের নৌ-ট্রাফিক সিগন্যাল কার্যালয়ের ট্রাফিক মো. আবুল কালাম বলেন, শেলা নদীর চ্যানেল দিয়ে জাহাজ চলাচল বন্ধের পর ঘষিয়াখালী চ্যানেল দিয়ে জাহাজ চলাচল করার জন্য সরকার ঘোষণা দিয়েছে। কিন্তু ঘষিয়াখালী চ্যানেলের নাব্যতা হ্রাস ও বিভিন্ন স্থানে অসংখ্য ডুবোচরের কারণে ওই পথে জাহাজ চলাচলও ঝুঁকিপূর্ণ। তাই মালবাহী জাহাজগুলো নোঙর করে রাখা ছাড়া তাদের অন্য কোনও উপায় নেই।

তার ভাষ্যমতে, দুর্ঘটনার পর থেকে গতকাল শনিবার পর্যন্ত অন্তত ৩০০ মালবোঝাই নৌযান অান্তর্জাতিক নৌচ্যানেল ‘গাবখান চ্যানেল’ অতিক্রম করেছে। কীর্তনখোলা, সুগন্ধা, গাবখান, সন্ধ্যা, কঁচা, বলেশ্বর, শরণখোলার বগিরখাল, মড়াপোলা সুপতি, শেলা, হরিণধরা, অন্ধারমানিক (শোলা), জয়মনি, পশুরনদ, মংলা পর্যন্ত নদ-নদীতে অন্তত ৫০০ নৌযান নোঙর করে আছে। এখন জাহাজগুলো বঙ্গোপসাগর ধওর মংলা পৌঁছতে পারে। কিন্তু ওই জাহাজগুলোর ইঞ্জিনের কার্যক্ষমতা এবং জাহাজের আকার ছোট হওয়ায় দুর্ঘটনার সম্ভাবনা থেকে যাচ্ছে। তাছাড়া গভীর সমুদ্র দিয়ে ওই জাহাজগুলো চলাচল করলে লবণ পানিতে নষ্ট হবে। তাই বিকল্প নৌপথ দিয়ে জাহাজগুলো চলাচল করছে না।

বরিশাল বিআইডাব্লিটএ-র উপ-পরিচালক (নৌ সংরক্ষণ ও ট্রাফিক বিভাগ) আবুল বাশার মজুমদার বলেন, সরকারের নির্দেশে শেলা নৌ রুট বন্ধ রয়েছে। পরবর্তী সিদ্ধান্ত না নেওয়া পর্যন্ত ওই রুটে সকল ধরনের নৌযান চলাচল বন্ধ থাকবে। এ অবস্থায় কোনও নৌযান এই রুট থেকে প্রবেশ এবং বের হতে পারবে না। তিনি আরো বলেন, গাবখান চ্যানেলের কাউখালী প্রান্তের পাইলট অফিস থেকে প্রতিটি জাহাজ একজন করে পাইলট নিয়ে থাকেন। প্রায় ১৬ ঘন্টা চালানোর পর সন্ধ্যা থেকে শেলা হয়ে মংলা বন্দরে জাহাজ পৌছায়। এর জন্য একজন পাইলট ৬০০ টাকা পেয়ে থাকেন। কাউখালীতে ২৪ জন পাইলট রয়েছে। মংলা প্রান্তে পাইলট রয়েছে আরো ৪০ জনের মতো। দুর্ঘটনার আগে প্রতিদিন গড়ে অন্তত ২৫টি জাহাজ এই রুটে চলাচল করত।