জাহিদুর রহমান: ব্যস্ত ও যান্ত্রিক শহর ঢাকায় অনেকেই একটু স্বস্তির আশায় গৃহকর্মী নিয়োগ করেন। কিন্তু এই গৃহকর্মীই এক সময় স্বস্তির পরিবর্তে অস্বস্থির কারণ হয়ে দাঁড়ায়। গৃহকর্মীর কাছ থেকে পারিবারিক কাজে সহায়তার পরিবর্তে অনেকেই উল্টো মহা বিপদে পড়েন।
গৃহকর্মী সেজে একটি প্রতারক চক্র রাজধানীতে নগদ টাকা ও স্বর্ণালংকারের পাশাপাশি ঘরের মূল্যবান সামগ্রি লুটে নিয়ে যায়। শুধু তাই নয়, ওই প্রতারক দলের হাতে প্রাণও হারিয়েছেন অনেকে।
রাজধানীর বিভিন্ন এলাকায় গৃহকর্মীবেশী অন্তত ১০টি প্রতারকচক্র সক্রিয় রয়েছে বলে গোয়েন্দা পুলিশের একটি সূত্র নিশ্চিত করেছে। প্রতিটি দল নিজেদের মধ্যে এলাকা ভাগ করে প্রতারণার সুযোগ খুঁজতে থাকে।প্রতারক চক্রের প্রতিটি দলে চার-থেকে পাঁচজন সদস্য ও একজন দলনেতা রয়েছে। এই দলনেতাই প্রত্যেককে বিভিন্ন বাসায় কাজ ঠিক করে দেয়। বিনিময়ে প্রতারণা করে পাওয়া সম্পদের একটি নির্দিষ্ট অংশ দলনেতাকে দিতে হয়।
অভিনব এ প্রতারণা সম্পর্কে র্যাব জানায়, রাজধানীর অনেক দম্পতি উভয়েই চাকরি করার কারণে খুব বেশি যাচাই-বাছাই না করেই গৃহকর্মী নিয়োগ করে থাকে। এছাড়া এই চক্রটি সম্পর্কে সাধারণ মানুষ খুব একটা অবগতও নয়। এই সুযোগটিই গ্রহণ করছে অপরাধীরা।
রাজধানীতে কয়েক মাসে এ ধরনের অসংখ্য প্রতারণার ঘটনা ঘটেছে। যদিও এসব ঘটনার সঠিক কোনো পরিসংখ্যান নেই পুলিশের কাছে। আর তাই আড়ালেই থেকে যাচ্ছে ভয়ঙ্কর এসব অপরাধী।
গত বছর নভেম্বরের দিকে ধানমন্ডির সেন্ট্রাল রোডের বয়োবৃদ্ধ গৃহকর্ত্রী আমেনা বেগমকে জবাই করে খুন করে রাসেল নামের এক গৃহপরিচারক। স্বর্ণালংকারসহ ঘরের মূল্যবান সামগ্রী নিয়ে পালিয়ে গেলেও এর কিনারা করতে পারেনি ধানমন্ডি থানা পুলিশ।
ব্যাংক কর্মকর্তা আক্তার কামাল তালুকদার। তিনি রাজধানীর বসুন্ধরা আবাসিক এলাকার বাসিন্দা। তার বাসায় মর্জিনা আক্তার শিউলী নামে এক নারী গৃহকর্মী কাজ করতেন। গত ১৯ জানুয়ারি শিউলী বাসার সবাইকে চেতনানাশক ওষুধ খাইয়ে স্বর্ণালংকারসহ প্রায় ১০ লাখ টাকার মালামাল নিয়ে পালিয়ে যায়।
গত ১৭ নভেম্বর রাতে চকবাজারের জয়নাগ রোডের হাজি মোহাম্মদ তাজউদ্দিনের বাসার সকলকে রাতের খাবার পরিবেশন করে গৃহকর্মী স্বপ্না বেগম (২৮)। পরদিন সকালে কারো সাড়া শব্দ না পেয়ে প্রতিবেশিরা তাজউদ্দিনের বাসার নয় সদস্যকে অচেতন অবস্থায় উদ্ধার করে হাসপাতালে ভর্তি করেন। বাসা থেকে খোয়া যায় নগদ টাকা, সোনার অলঙ্কার, দুটি মোবাইল ফোন ও মূল্যবানসামগ্রী। লাপাত্তা হয়ে যায় স্বপ্না বেগম।
ঘটনার তিনদিন পর কেরানীগঞ্জ এলাকা থেকে আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যরা গ্রেফতার করে স্বপ্নাকে। পুলিশের জিজ্ঞাসাবাদে সে জানায়, ঘটনার মাত্র তিনদিন আগে সে ওই বাসায় গৃহকর্মী হিসেবে কাজ নেয়। ঘটনার রাতে খাবারের সঙ্গে চেতনানাশক ওষুধ মিশিয়ে পরিবারের নয় সদস্যকে খেতে দেয়। এতে সবাই অচেতন হয়ে পড়ে। পরে মালামাল নিয়ে সে কেটে পড়ে।
প্রকৗশলী মোহম্মদ শফিকুল ইসলাম।তিনি রাজধানীর মোহাম্মদপুরের তাজমহল রোডের বাসিন্দা। গত ৯ ফেব্রুয়ারি তার দুই মেয়ে ও স্ত্রীকে সকালের নাস্তার সঙ্গে চেতনানাশক ওষুধ খাইয়ে অজ্ঞান করে স্বর্ণালংকারসহ প্রায় ১৫ লাখ টাকার মালামাল নিয়ে সটকে পড়ে গৃহকর্মী হাজেরা বেগম।
হাজারীবাগের টালী অফিস রোডের ২৯১/বি, নম্বর বাসা। প্রবাসী গৃহকর্তা এনামুল হক। তার স্ত্রী তাসলিমা আক্তার সাত বছরের ছেলেকে নিয়ে একাই বাসায় থাকেন। দীর্ঘদিন ওই বাসায় কাজ করতেআ গৃহকর্মী আশা। রাতে তাসলিমাকে খাবারের সাথে চেতনানাশক ওষুধ মিশিয়ে খাইয়ে শ্বাসরোধ করে হত্যা করে আশা ও তার সহযোগীরা। পরে তারা ৭০ হাজার টাকা ও চারভরি সোনার অলঙ্কার নিয়ে পালিয়ে যায়।
নাম তার শিউলি চুন্নি। তবে কখনও হোসনা, কখনও ফারজানা আবার কখনও লাকী ছদ্ম নাম ব্যবহার করে। পরিচয় গৃহকর্মী। কাজের বুয়ার ছদ্মাবরণে সে একের পর এক চুরির ঘটনা ঘটিয়ে যাচ্ছে। অভিনব কৌশলে ভুয়া নাম ঠিকানা ব্যবহার করে শিউলি কাজ নেয়। কাজ নেয়ার কয়েক দিনের মধ্যেই সে নগদ টাকা-পয়সা, সোনার অলঙ্কার নিয়ে চম্পট দেয় গাইবান্ধার গোবিন্দগঞ্জে। এভাবেই সে এখন কোটিপতি। গত আট বছরে শিউলি প্রায় সাড়ে তিনকোটি টাকার সোনার অলঙ্কার চুরি করেছে।
শিউলির রয়েছে শক্তিশালী সিন্ডিকেট। তার নিজের বাসায়ই রয়েছে তিনজন কাজের বুয়া। ৩৮ বছর বয়সী শিউলির বিয়ে করে ৪টি। চুরির টাকায় তিন ভাই-বোনকে বিদেশ পাঠিয়েছে।
নগদ টাকা ও স্বর্ণালঙ্কার আছে-এমন বাড়িই প্রতারণা চক্রের প্রথম টার্গেট।
এসব প্রতারক চক্রকে গ্রেফতারে পুলিশের ভূমিকা সম্পর্কে ডিএমপির ডিসি (মিডিয়া) মো. মাসুদুর রহমান বলেন, গৃহকর্মী সেজে বাসার লোকজনকে অজ্ঞান করে সর্বস্ব লুটে নেয়ার ঘটনা বেড়েছে। তবে নাগরিকদের সচেতনতাই এ ধরনের অপরাধ নিয়ন্ত্রণে যথেষ্ট। তা না হলে যেকোনো ধরনের অপ্রীতিকর ঘটনার শিকার হবেন নিজেরাই।
তিনি বলেন, গৃহকর্মী ছদ্মবেশে থাকা চক্রকে গ্রেফতার করতে পুলিশের একটি টিম কাজ করছে।