কিশোরগঞ্জ থেকে মোস্তফা কামাল : কিশোরগঞ্জে মৎস্য বিভাগের ৯টি পুকুরের ৬টি ভরাট করে নির্মিত হচ্ছে ফিসারি ডিপ্লোমা ইনস্টিটিউট। বন্ধ করে দেয়া হয়েছে পোনা উৎপাদনকারি হ্যাচারিও। এর ফলে পোনা সরবরাহে বিপর্যয় নেমে আসার আশংকা করা হচ্ছে ।
জেলার বিভিন্ন স্থানে ব্যক্তিগত এবং উন্মুক্ত জলাশয়ে আগে যে পরিমাণ পোনা সরবরাহ করার ক্ষমতা ছিল, সেই ক্ষমতা এখন মৎস্য বিভাগ হারিয়ে ফেলেছে। ফলে হুমকির মুখে পড়েছে জেলার কৃত্রিম মৎস্য চাষ ব্যবস্থা। ফিসারি ডিপ্লোমা ইনস্টিটিউট প্রতিষ্ঠা হওয়ায় এখানে শিক্ষার একটি নতুব দ্বার উন্মোচিত হয়েছে ঠিক, কিন্তু প্রতিষ্ঠান নির্মাণ করতে গিয়ে মৎস্য উৎপাদনকে হুমকির মুখে ঠেলে দেয়া হয়েছে।
জেলা সদরে মৎস্য বিভাগের জায়গার ওপর ২০১৪ সালের জুলাই মাস থেকে শুরু হয়েছে মৎস্য ডিপ্লোমা ইনস্টিটিউটের নির্মাণ কাজ। এর একাডেমিক ভবন ও অফিস ভবনের নির্মাণকাজ ইতোমধ্যে শেষ হয়েছে। ছাত্র ও ছাত্রী হোস্টেলের নির্মাণকাজ চলমান আছে। ইনস্টিটিউটের সাব-কণ্ট্রাক্টর আব্দুল মতিন জানান, পুরো প্রকল্পটির নির্মাণশাজ জুন মাসে সম্পন্ন হবার কথা রয়েছে।
জেলা মৎস্য খামার ব্যবস্থাপক মোস্তফা রুহুল আমিন এ প্রতিনিধিকে জানান, জেলা শহরের পশ্চিম প্রান্তে মৎস্য বিভাগের ৯টি পুকুরসহ মোট জমি ছিল ৯ দশমিক ৫৭ একর। এই জমিতে জেলা মৎস্য কার্যালয়, খামার কার্যালয়, হ্যাচারিসহ অন্যান্য স্থাপনার পাশাপাশি ৯টি পুকুরও ছিল। আর ৯টি পুকুরের আয়তন ছিল ৩ দশমিক ৮ একর। এসব পুকুরে কার্প জাতীয় মাছ, শিং ও কৈ মাছের পোনা উৎপাদন এবং মিশ্র মাছের চাষ করা হতো।
এই খামার এবং হ্যাচারি থেকে জেলার দুই শতাধিক মৎস্য চাষিকে যেমন উন্নত মানের পোনা ও রেনু সরবরাহ করা হতো, পাশাপাশি সরকারি উদ্যোগে উন্মুক্ত জলাশয়েও পোনা অবমুক্ত করা হতো। গত ১০ বছরের হিসাব দেখিয়ে তিনি বলেন, এই খামার সবসময়ই লাভজনক ছিল। প্রতি বছর যে পরিমাণ লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হতো, সবসময়ই তা অতিক্রম করে যেত। যেমন ২০০৫ সালে ১ লাখ ৭ হাজার টাকা আয় করার লক্ষ্যমাত্রা ঠিক করা হয়েছিল। কিন্তু লক্ষ্যমাত্রা ছাড়িয়ে আয় হয়েছিল ১ লাখ ৭৯ হাজার ৬০০ টাকা। আবার সর্বশেষ ২০১৪ সালে ২ লাখ ১৬ হাজার টাকা আয় করার লক্ষ্যমাত্রা ঠিক করা হয়েছিল। কিন্তু আয় হয়েছে ২ লাখ ৩০ হাজার টাকা। এখানে হ্যাচারিতে রেনু উৎপন্ন হতো বছরে প্রায় ৫০ কেজি। প্রায় এক লাখ থাই কৈ মাছের পোনা, ৪ লাখ কার্প জাতীয় মাছের পোনার পাশাপাশি মিশ্র মাছের চাষ করা হতো প্রায় সাড়ে ৬শ কেজি।
খামার ব্যবস্থাপক মোস্তফা রুহুল আমিন আরও বলেন, ৯টি পুকুরের মধ্যে মৎস্য ইনস্টিটিউট নির্মাণ করতে গিয়ে ৬টি পুকুরই ভরাট করা হয়েছে। এখন ১ দশমিক ৩২ একরের তিনটি পুকুর অবশিষ্ট রয়েছে। পাশাপাশি হ্যাচারিটিও বন্ধ হয়ে গেছে। ফলে মৎস্য চাষিদের চাহিদা পূরণ করা দুষ্কর হয়ে যাবে। এমনকি সরকারি উদ্যোগে উন্মুক্ত জলাশয়ে যেসব পোনা অবমুক্ত করা হতো, সেই কার্যক্রমও ব্যাহত হবে। তবে বিকল্প জায়গায় পুকুর ও হ্যাচারিসহ খামার তৈরি করতে পারলে এ সঙ্কট মোকাবেলা করা যেত বলে তিনি মন্তব্য করেন।
জেলা মৎস্য কর্মকর্তা ড. মজিবুর রহমান জানান, সরকারি জায়গায় সরকার মৎস্য ইনস্টিটিউট নির্মাণ করলে এ ব্যাপারে আমাদের তো কিছু করার থাকে না। তিনি বলেন, জেলা সদর এবং কটিয়াদীতে দুটি সরকারি মৎস্য খামার রয়েছে, আর প্রাইভেট খামার রয়েছে ৯টি। অথচ ময়মনসিংহে ৭টি সরকারি খামার রয়েছে। প্রাইভেট খামারও রয়েছে প্রচুর। কিন্তু ময়মনসিংহের খামার থেকে কিশোরগঞ্জের মৎস্য চাষিরা পোনা আমদানি করতে গেলে খরচ পড়ে যায় বেশি। কাজেই জেলার প্রধান মৎস্য উৎপাদনকারি এলাকা হাওরাঞ্চলে সহজে পোনা সরবরাহের জন্য করিমগঞ্জের চামড়া নৌবন্দর এলাকায় একটি এবং জেলার পশ্চিম প্রান্তে হোসেনপুরে একটি মৎস্য খামার করতে পারলে পোনার চাহিদা পূরণ করা সহজ হতো বলে তিনি জানান।
জেলা মৎস্য কর্মকর্তা আরো জানান, দিন দিনই জেলায় মৎস্য চাষে নতুন নতুন পদ্ধতি উদ্ভাবিত হচ্ছে, পোনার চাহিদাও বাড়ছে। যেমন নিকলী, ভৈরব, বাজিতপুর, কুলিয়ারচর এবং জেলা সদরের দানাপাটুলি এলাকাসহ বিভিন্ন এলাকায় বর্ষাকালে প্লাবন ভূমিতে বাঁশের ঘণ বেড়ার (বানা) ঘেরাও দিয়ে এর ভেতর পোনা ছেড়ে ‘প্যান’ পদ্ধতিতে মাছের চাষ করা হয়। প্যান পদ্ধতিতে প্লাবন ভূমিতে প্রায় চার মাস বর্ষার পানিতে মাছ চাষ করা যায়। কিন্তু এর জন্য পর্যাপ্ত পোনার প্রয়োজন। এছাড়াও জেলায় ৬৯ দশমিক ৪৮ হেক্টর জায়গার ওপর ১৪৯টি সরকারি পুকুর রয়েছে যেখানে ২৪৫ টন মাছ উৎপন্ন হয়। আর ৩ হাজার ৩১৫ দশমিক ২৬ হেক্টর জায়গার ওপর ২৬ হাজার ৬৩৪টি বেসরকারি পুকুর রয়েছে যেখানে ৯ হাজার ৯৪৫ টন মাছ উৎপন্ন হয়। এসব পুকুরসহ উন্মুক্ত জলাশয়ের পোনার চাহিদা পূরণ করা কঠিন হয়ে পড়েছে। কাজেই সরকারি উদ্যোগে আরো অন্তত দুটি খামার প্রতিষ্ঠা করা গেলে এসব চাহিদা অনেকাংশে পূরণ করা যাবে বলে জেলা মৎস্য কর্মকর্তা ড. মজিবুর রহমান মনে করেন।