মধুপুর (টাঙ্গাইল) থেকে আব্দুল্লাহ আবু এহসান: স্বাধীনতার মাসে আকুতি জানিয়ে মধুপুরের গারো পল্লীর আদিবাসী দুই মুক্তিযোদ্ধা বলেছেন আদিবাসীদের ভূমি সমস্যার সমাধান, মিথ্যা বন মামলা প্রত্যাহারসহ আদিবাসী হিসাবে স্বীকৃতি চাই। আদিবাসী দুই মুক্তিযোদ্ধা ধীরেন্দ সাংমা ও চীন সাংমা আক্ষেপ করে বলেন, দেশের প্রতি ভালবাসার টানে জীবন বাজি রেখে মহান মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করে দেশ স্বাধীন করলাম। কিন্তু জাতি হিসাবে স্বীকৃতি পেলাম না ও ভূমি সমস্যার সমাধানও হলো না। তারপরও বলি “কি পেলাম আর কি পেলাম না, এটাকে আমরা বড় করে দেখি না। কারণ র্দীঘদিন যুদ্ধ করে বাংলার মাটিতে লাল সবুজের পতাকা প্রতিষ্ঠিত করতে পেরেছি এটাই আমাদের বড় পাওয়া।”
আদিবাসী বীর মুক্তিযোদ্ধা ধীরেন্দ্র সাংমা (৭৩) ও চীন সাংমা (৭৪)। তাদের দুজনেরই বাড়ি টাঙ্গাইলের মধুপুর উপজেলার গড়াঞ্চলের অরণখোলা ইউনিয়নের ধরাটি গ্রামে। বয়সে দুজনই সমসাময়িক এবং ঘনিষ্ঠ বন্ধু। শেষ বয়সে তারা দুজনই এখন এক সাথে চলাফেরা করেন। তাদের সাথে একত্রে কথা হয় ধনবাড়ীতে। মুক্তিযুদ্ধকালীন তাদের বয়স ছিল প্রায় ৩৪/৩৫ বছর। বর্তমানে দুজনেই কৃষি কাজ করেন। সারাদিন পরিশ্রম করে দু’বেলা পেটপুরে খাওয়াই কষ্টসাধ্য। দু:খ কষ্ট তাদের নিত্যসঙ্গী বলে তারা জানান।
ধীরেন্দ্র সাংমা ৮ ছেলে, ২ মেয়ের জনক। স্ত্রী পালিনা মারাক। ১ ছেলে শিক্ষকতা করেন। বাকী ৭ জনই করেন কৃষি কাজ। মেয়ে দুজনকে বিয়ে দিয়েছেন। চীন সাংমার ২ ছেলে ২ মেয়ে আর স্ত্রী প্রণিকা মারাক, এই নিয়েই তার সংসার। ২ মেয়ে বিয়ে দিয়েছেন। এক ছেলে বেকার আর একজন কৃষি কাজ করেন। তারা দুজনই অকৃত্রিম ভালোবাসার টানে ১৯৭১ সালে জীবন বাজি রেখে বীরদর্পে ঝাপিয়ে পড়েছিলেন মহান মুক্তিযুদ্ধে।
কেন যুদ্ধে গেলেন এমন প্রশ্নের জবাবে তারা বলেন, দেশব্যাপী পাক হানাদার বাহিনী ও তাদের দোসর আলবদর আলশামস-রাজাকার বাহিনীর বর্বরোচিত হত্যাযজ্ঞ আর অসহায় মা-বোনের ইজ্জত লুন্ঠনের বর্ণনা শুনেই আমরা যুদ্ধে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেই। ইংরেজি তারিখ বলতে পারবোনা। তবে আমরা দুজন যেদিন মহান মুক্তিযুদ্ধে অংশ গ্রহণের জন্য রওনা হই, সেদিন ছিল ১০ই আষাঢ়। তারা যুদ্ধে অংশগ্রহণের বর্ণনা দিয়ে জানান, “প্রথমে প্রশিক্ষণের জন্য জামালপুরের পিয়ারপুর হয়ে ব্রহ্মপুত্র পাড়ি দিয়ে পৌঁছাই ভারতের মেঘালয়ের তুরা জেলার রংনাবাগ ক্যাম্পে। থ্রী নট থ্রী, এলএমজি, এসএমজি, এমএমজি এবং গ্রেনেডসহ বিভিন্ন অস্ত্র চালানো ও গেরিলা প্রশিক্ষণ গ্রহণ করি”।
প্রশিক্ষণ শেষে ফুলছড়িঘাট, মহেন্দ্রগঞ্জ, টাঙ্গাইলের এলাসিনঘাট, মাদারগঞ্জ, কেদারপুর, শেরপুরের কামালপুর, ধানুয়া কামালপুর, চিচিংপাড়া, নকসি, কর্ণজোড়া বাজার, আহম্মদপুরসহ বিভিন্ন স্থানে মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করে পাক-হানাদার বাহিনীর বিরুদ্ধে যুদ্ধ করে লাল সবুজের পতাকা হাতে বিজয়ীর বেশে ফেরেন এই দুই আদিবাসী মুক্তিযোদ্ধা। তারা ১১নং সেক্টরে যুদ্ধ করেছিলেন।
চীন সাংমা ও ধীরেন্দ্র সাংমা আক্ষেপ করে বলেন, “জীবন বাজি রেখে দেশের জন্য যুদ্ধ করলাম। যুদ্ধ করে দেশ স্বাধীন করলাম কিন্তু স্বাধীন দেশেও জাতি হিসাবে আদিবাসী স্বীকৃতি পেলাম না। ‘উপজাতিই’ রয়ে গেলাম”। তারা বলেন, “আজ যদি বঙ্গবন্ধু বেঁচে থাকতেন তাহলে হয়ত এমনটি হতোনা। কেননা তিনি আমাদেরকে অন্তর থেকে ভালবাসতেন এবং গুরুত্ব দিতেন। আর এ জন্যইতো তিনি যুদ্ধের পর আদিবাসী অধ্যোসিত মধুপুরের চুনিয়া কটেজের নিরিবিলি স্থানে এসে একান্ত মনে বসে স্বাধীন বাংলাদেশের ৭২ এর সংবিধানের খসড়া গড়ায় মনোনিবেশ করেছিলেন। এবং এ সময় তিনি মধুপুরের প্রয়াত আদিবাসী পরেশ চন্দ্র সাংমার মধ্যাহ্ন ভোজে সানন্দে অংশ নিয়েছিলেন”।
তারা বলেন, “নিজেদের জন্য কিছু চাইনা। শুধু বলতে চাই বিভিন্ন সময় বিভিন্ন সরকার আদিবাসীদের ভূমি সমস্যাসহ স্বার্থ সংরক্ষণে বন আইন সংস্কার করার কথা বললেও কোনও সরকারই তা কার্যকর করেনি”।
তারা যুদ্ধাপরাধীদের বিচার ত্বরান্বিত করারও দাবি জানান।