খুলনা থেকে সোহরাব হোসেন:পশ্চিম সুন্দরবন বনবিভাগের খুলনা ও সাতক্ষিরা রেঞ্জের স্থানীয় ফরেস্ট স্টেশনের মাধ্যমে অনুমতি নিয়ে প্রথম দফায় সহস্রাধিক মৌয়াল বনে প্রবেশ করেছেন। টানা একমাস তারা মোম ও মধু সংগ্রহ করতে পারবেন বলে জানিয়েছে বনবিভাগ।
এদিকে মৌয়ালদের অভিযোগ, সরকারি রাজস্ব পরিশোধ করে বনে ঢোকার আগেই অনুমতিধারি মৌয়ালদের কাছে মোবাইলের মাধ্যমে বনদস্যুরা দল প্রতি ২০ হাজার টাকা চাঁদা দাবি করছে। এ কারণে আতঙ্ক নিয়েই বনে প্রবেশ করতে হচ্ছে মৌয়ালদের। আবার অনেকেই বাড়ি থেকে বনদস্যুদের দাবিকৃত চাঁদার টাকা পরিশোধ করে মধু মহলে প্রবেশ করছেন।
সুন্দরবন পশ্চিম বিভাগের খুলনা ও সাতক্ষিরা রেঞ্জ অফিস সুত্রে জানা গেছে, ১ এপ্রিল থেকে এ পর্যন্ত ১শ’ তিনটি অনুমতি নিয়েছেন মৌয়ালরা। মধু ও মোম সংগ্রহের জন্য এবার জন প্রতি ৭৩০ টাকা রাজস্ব নির্ধারণ করা হয়েছে এবং প্রতিটি অনুমতি নিয়ে এক দলে সর্বোচ্চ আট জন মৌয়াল বনে প্রবেশ করতে পারবেন।
এ মৌসুমে বিভাগের দুটি রেঞ্জ থেকে সংগ্রহের জন্য লক্ষমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে ২ হাজার ২শ’ পঞ্চাশ কুইন্টাল বা ৫ হাজার ৬শ’ ২৫ মণ মধু ও ৫শ’ নব্বই কুইন্টাল বা ১ হাজার ৪শ’ ৭৫ মণ মোম। যদি তারা মৌসুম জুড়ে নিরাপদে মোম ও মধু সংগ্রহ করতে পারেন তবেই বনবিভাগের নির্ধারিত লক্ষ্যমাত্রা অর্জিত হতে পারে। আর যদি বনদস্যুদের উৎপাত বৃদ্ধি পায় তাহলে মৌয়ালরা নিরুৎসাহিত হবে এবং লক্ষ্যমাত্রা অর্জন ব্যহত হবে।
সুন্দরবন সংলগ্ন কয়রা উপজেলার মঠবাড়ি গ্রামের মৌয়াল মজিবর বলেন, “ঠিক মতো মহলে ঢুকতি পারলি আশা করি এবার মৌ আগের বারের চাইতে ভাল পাবো। কারণ এবার আবহাওয়া ভাল থাকায় বনে মৌচাক বেশি পাবার কথা। কিন্তু এবার ডাকাতির চাপ যে পরিমাণ দেখতিছি তাতে চালান বাচায়ে বাড়ি ফিরতি পারবো কিনা বুঝতিছি নে”।
একই আশংকার কথা ব্যক্ত করেছেন উপজেলার দক্ষিণ বেদকাশি গ্রামের মৌয়াল কওছার গাজী, শ্যামনগর উপজেলার গাবুরা গ্রামের মৌয়াল নুর বকস মোল্যাসহ শতাধিক মৌয়াল। তারা বলেন, মহাজনের কাছ থেকে দাদন নিয়ে দীর্ঘকাল আমরা বনে বাঘের ভয় উপেক্ষা করে মোম মধু সংগ্রহ করে আসছি। কোন বার লাভ বেশি পাই আবার কোন বার চালানটা ফিরে আসে। এ পেশাটি আমাদের কাছে নেশার মত হয়ে গেছে পৈত্রিক সূত্রে পাওয়া এই ব্যাবসাটি চাইলেও ছাড়তে পারিনা। কিন্তু বর্তমানে বনদস্যুদের অত্যাচার ও চাঁদার মাত্রা বেড়ে যাওয়ায় কষ্টের রোজগার ও দাদনের টাকা ফিরিয়ে আনা কঠিন হবে বলে মনে করেন এসব পেশাদার মৌয়ালরা। আবার মধু সংগ্রহে এসব খরচের পরিমাণ বৃদ্ধি হওয়ায় অনেকেই চালান বাঁচাতে মধুর সঙ্গে বিভিন্ন উপকরণ মিশ্রিত করে লোকালয়ে আনতে বাধ্য হচ্ছেন বলে অনেক মৌয়াল জানিয়েছেন। তবে এ কাজে পেশাদার মৌয়ালদের মন সায় দেয়না এমন কথাও বলেছেন তারা।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে মৌয়ালরা জানান, আলিফ বাহিনি, তালেব বাহিনি, ফরহাদ বাহিনি, মঞ্জু বাহিনীসহ কমপক্ষে ১০/১২ টি দস্যু বাহিনীর চাঁদার টাকা পরিশোধ করে বনবিভাগের অনুমতির মত আরো একটি অনুমতি নিয়ে বনে ঢুকতে হয় তাদের। তারা দাবি জানান, এ মৌসুমে সুন্দরবনের গহীনে কোষ্টগার্ডের পাশাপাশি র্যাব ও পুলিশের সার্বক্ষণিক টহলের ব্যবস্থা করলে মৌয়ালরা নির্বিঘেœ মধু ও মোম সংগ্রহ করতে পারবেন। এ ব্যাপারে কয়রা থানা অফিসার ইন্চার্জ ইনেসপেক্টর হরেন্দ্র নাথ সরকার জানান ইতোমধ্যে কয়েকটি বনদস্যু বাহিনী প্রধান ও তাদের সহযোগীদের নির্মূল করা হয়েছে। কিছুটা হলেও চলতি মৌসুমে মৌয়াল তাদের পেশাগত কাজ নির্বিঘেœ করতে পারবে।
পশ্চিম সুন্দরবনের খুলনা রেঞ্জের সহকারি বন সংরক্ষক ওসমান গনি বলেন, এবার সুন্দরবনে প্রবেশের আগে মৌয়ালদের সব রকমের প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়েছে। মৌয়ালদের নিরাপত্তার বিষয়টি নিয়েও আলোচনা চলছে। সব দিক ঠিক থাকলে এবং মৌয়ালরা নির্বিঘেœ মধু সংগ্রহ করে ফিরতে পারলে লক্ষামাত্রা ছাড়িয়ে যাবে বলে আশা প্রকাশ করেন তিনি। তিনি জানান, সুন্দরবনে মোম ও মধু সংগ্রহের জন্য ১ এপ্রিল থেকে ৩০ জুন পর্যন্ত তিন দফায় মৌয়ালদের অনুমতি দেওয়া হবে। এর মধ্যে দ্বিতীয় দফায় অর্থাৎ মে মাসে মৌয়ালরা মধু সংগ্রহ বেশি করেন বলে জানান তিনি।