শেরপুর থেকে রেজাউল করিম বকুল: ক্রমেই বাড়ছে বন্যহাতির হামলা। সেইসাথে বাড়ছে নিহতের সংখ্যা। রাত জেগে গ্রাম পাহাড়া দিচ্ছে এলাকাবাসী। তবুও রক্ষা করতে পারছেনা জানমাল। আহত বা নিহতের খবর শোনা যায় প্রায়ই। বন্যহাতি ক্ষেতের ফসল আর ফলজ বাগানেও হানা দিচ্ছে। হাতির আক্রমণে তারা চরম নিরাপত্তাহীনতায় ভুগছেন। এ কারণে ওদের টিকে থাকা বড় চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছে।
শেরপুর শহর থেকে ৩০/৩৫ কিলোমিটার দূরে শ্রীবরদী, ঝিনাইগাতী ও নালিতাবাড়ী উপজেলার কিছু অংশ জুড়ে সীমান্ত এলাকায় গারো পাহাড়। এলাকাটি ভারতের মেঘালয় রাজ্য ঘেষাঁ। এর মধ্যে ক্ষুদ্র নৃ-তাত্ত্বিক জনগোষ্ঠীর লোকের সংখ্যাই বেশি। এখানে গারো, কোচ, হাজং, বানাইসহ বিভিন্ন ধর্মের লোকজনের বসবাস।
গারো পাহাড় সংলগ্ন এলাকাবাসী দীর্ঘদিন যাবত নিরাপত্তার দাবি করছেন। কিন্তু কার্যকর পদক্ষেপ না নেওয়ায় গারো পাহাড়ের লোকালয়ে বন্যহাতির হামলা থামানো যাচ্ছে না। ঘটছে হতাহতের ঘটনা। হাজার হাজার একর জমির ধান, মৌসুমি ফল ও বন বাগানের বিপুল পরিমান গাছপালা ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। লন্ডভন্ড হচ্ছে ঘরবাড়ি। হাতির অত্যাচারে অন্যত্র চলে গেছে অনেকে। যারা রয়েছেন তাদের জীবনও দুর্বিসহ হয়ে পড়েছে। নির্ঘুম রাত কাটান তারা। যুদ্ধ করেন বন্যহাতির সাথে। এ যুদ্ধে মানবেতর জীবন কাটাতে হচ্ছে ৩৫/৪০ টি গ্রামের বাসিন্দাদের।
গ্রামবাসীরা জানান, গারো পাহাড়ে রয়েছে শতাধিক বন্যহাতির কয়েকটি দল। প্রায় এক যুগ ধরে বন্যহাতি রাতে হামলা চালিয়ে আসছে। ক’মাস যাবত দিনের বেলাতেও তারা হামলা চালায়। প্রতি রাতে টর্চ লাইট, হারিকেন, মশাল, থালা বাসন, ঢোল, বল্ল¬¬ম, পটকাসহ নানা কিছু নিয়ে দলবদ্ধভাবে হাতি তাড়ানোর চেষ্টা করেন তারা। বেসরকারি সংস্থা সিডিএসের তথ্য মতে, এক যুগে বন্যহাতির আক্রমণে সোমনাথপাড়া গ্রামের কৃষক ফিলিপ সাংমা, হারিয়াকোনা গ্রামের গৃহবধূ নেপালিয়ান মারাক, কৃষক স্টারসন মারাক, বড় গজনী এলাকার মন্দিরা মারাকসহ প্রায় অর্ধশত লোক নিহত হয়েছে। পঙ্গু হয়েছে প্রায় শতাধিক। সহাস্রাধিক লোকের ঘরবাড়ি ভাঙচুর করেছে। প্রায় ৭শ গরু ছাগল নিহত হয়েছে। প্রতি বছর দু’সহাস্রাধিক একর জমির ধান ক্ষেতসহ ফসলের ব্যাপক ক্ষতি হচ্ছে। এলাকার বন বাগানগুলোও রক্ষা পাচ্ছে না।
দিঘলাকোনা গ্রামের আহত কৃষক মৃতিলা মারাকের মেয়ে রোজিনা মারাক জানায়, বিকেল হলেই হাতির দল পাহাড় থেকে নেমে আসে ধান ক্ষেতে। ধান পাকার আগেই ক্ষেতের ধান বিনষ্ট করে। কৃষক চিনেশ্বর মারাক বলেন, বাড়ি ঘরেও হামলা করে। এখন আমাদের সব সময় হাতির ভয়ে আতংকে থাকতে হয়। গৃহবধূ মিথিলা মারাক বলেন, বন্যহাতিকে মামা বলে সম্মোধন করি। তার কাছে প্রাণ ভিক্ষা চাই। এ ছাড়া যেন আর কোনো উপায় নেই।
ইউপি সদস্য মুক্তিযোদ্ধা ভূপেন্দ্র মান্দাসহ সেখানকার লোকজন শোনান একই কথা। তিনি বলেন, হাতির তা-ব থেকে রক্ষা পেতে বিদ্যুতের দাবি করা হচ্ছে। এ দাবি পূরণ না হওয়ায় জানমাল নিয়ে মারাত্মক হুমকির মুখে পড়তে হচ্ছে তাদের।
উপজেলা ট্রাইবাল ওয়েল ফেয়ার এসোসিয়েশনের সাধারণ সম্পাদক প্রাঞ্জল এম সাংমা বলেন, এখানে উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা, জেলা প্রশাসক ও জেলা পুলিশ সুপার এসেছেন। হাতি আক্রমণের স্পর্শকাতর স্থানগুলো চিহ্নিত করেছেন। কিন্তু আজও কোনো পদক্ষেপ নেয়নি। এ ব্যাপারে উপজেলা এডিপি ওয়ার্ল্ড ভিশনের অর্থনৈতিক প্রকেল্পর দুর্যোগ বিষয়ক অফিসার হাফিজুর হক সোহাগ বলেন, এডিপির মাধ্যামে বন্যহাতি কবলিত এলাকায় কোরোসিনসহ নানা বিষয়ে সহযোগিতা করা হচ্ছে। শ্রীবরদী উপজেলা নির্বাহী অফিসার হাবিবা শারমিন বলেন, বর্তমান সরকার বন্যহাতির হামলায় আহতকে ৫০ হাজার আর নিহত হলে এক লাখ টাকা সহযোগিতা দিচ্ছেন । এ ছাড়াও স্থায়ী সমাধানের জন্য উর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে জানানো হয়েছে।
জেলা পল¬ী বিদ্যুৎ অফিস সূত্র জানায়, গারো পাহাড়ে বন্যহাতির আক্রমণ হতে রক্ষা পেতে ৫০ কিলোমিটার বিদ্যুৎতায়নের কর্মসূচি রয়েছে। তবে বন্যহাতির কবল থেকে রক্ষা করতে দ্রুত প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণের দাবি তুলেছেন এলাকাবাসী।