কামারুজ্জানের রায়ে সোহাগপুরে বিধবাদের চোখে আনন্দাশ্রু

শেরপুর থেকে রেজাউল করিম বকুল: “কামরুজ্জানকে সরকার  তারাতারি ফাঁসি দিলে আমরা খুশি অইব, সে আমগর স্বামী পিতা ও এলাকার পুরুষ মানুষ গরে মারছে, আল্লাহ তার বিচার করতাছে,  বাচপার লাইগা চাইলেও সে বাচপার পাইতোনা তার মরনী লাগবো।” কথাগুলো বলছিলেন সোহাগপুরের বিধাবপল্লীর বিধবা জবেদা বেওয়া। ৬ এপ্রিল একাত্তরের মানবতাবিরোধী অপরাধের দায়ে জামায়াতের সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল মুহাম্মদ কামারুজ্জামানের রিভিউ আবেদ খারিজ করে ফাঁসির রায় বহাল রাখার ঘোষণার পর প্রতিক্রিয়ায় তিনি এসব কথা বলেন।

Nalitabari-06
সোহাগপুরের বিধাবপল্লীর বিধবারা

ট্রাইব্যুনালের স্বাক্ষী বিধবা হাফিজা বেওয়া (৬০) বলেন “কামরুজ্জানের বিরুদ্ধে স্বাক্ষী দেওনের পর থাইকা রাইতে ঠিকমত ঘুমাইবার পাইতাম না। গত বছর যহন মৃত্যুদণ্ড রায় অয়, তহন আমরা বিরাট খুশি অইছিলাম, রায়ের বিরুদ্ধে আপিল করনের পর থাইকা মনের মধ্যে সারাদিন একটা চিন্তা কাম করতো। মৃত্যুদণ্ড বহাল থাহুনে হেই ডরডা কাইটা গেছে।” সোহাগপুর গণহত্যায় হাফিজার স্বামী ইব্রহীমসহ পরিবারের সাত সদস্যকে নির্বিচারে হত্যা করা হয়। তিনি  আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে স্বাক্ষ দিয়েছিলেন। হাফিজা খাতুনের বাড়ি শেরপুরের নালিতাবাড়ী উপজেলার সোহাগপুর গ্রামের বেনুপাড়ায়। যা এখন বিধবাপল্লী নামে পরিচিত।

একাত্তরের ২৫ জুলাই আলবদর, রাজাকার ও পাকিস্তানি বাহিনী নির্বিচারে হত্যাযজ্ঞ চালিয়েছিল সেখানে। বেনুপাড়ার সব পুরুষকেই (১৮৭জন) হত্যা করে পাড়াটিকে পরিণত করা হয়েছিল বিধবাপল্লীতে। সেদিন যে ৫৭ জন বিধবা হয়েছিলেন তাঁদের মধ্যে হাফিজাসহ ৩১ জন বেঁচে আছেন। কামারুজ্জামানের বিরুদ্ধে সাতটি অভিযোগের মধ্যে তৃতীয় অভিযোগ হলো সোহাগপুরে হত্যাযজ্ঞ ও ধর্ষণ। এই অভিযোগ প্রমাণিত হওয়ায় গত ২০১৩ সালের ৯ মে তাঁর বিরুদ্ধে মৃত্যুদণ্ডাদেশ দিয়েছিলেন আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-২।

এই রায়ের বিরুদ্ধে কামারুজ্জানের পক্ষ থেকে ৬ জুন আপিল করা হয়। সেই আপিলের রায়েও   ট্রাইব্যুনাল তাঁর মৃত্যুদণ্ড বহাল রাখেন। পরবর্তীতে ৫ মার্চ আপিল বিভাগের সংশ্লিষ্ট শাখায় রিভিউ আবেদ করে। সেই রিভিউ আবেদন খারিজ করে ৬ এপ্রিল প্রধান বিচারপ্রতির নেতৃত্বে ৪ জন বিচারপতি এই রায় দেন।

রায়ের পর সোহাগপুর গ্রামে গেলে একাত্তরে স্বামীহারা নারীদের চোখে দেখা গেছে আনন্দ অশ্রু। স্বজন ও গ্রামবাসী রায়ে সন্তোষ প্রকাশ করে রায় দ্রুত কার্যকর করার দাবি জানান। একাত্তরে স্বামীহারা করফুলি বেওয়া বলেন,“স্বাক্ষি দেওয়ার পর থাইকা রাতে ঘরের চালে কে বা কারা ডেল মারতো। এলাকার লোকজন ডর দেহাইতো। সরকার বইদল হইলে আমগর বিচার করবো। এর লাইগা সারাবেলা বিরাট ভয়ে ভয়ে থাকতাম। ফাঁসির রায় পূর্ণবহাল থাহুনে আমগর মনে স্বস্তি ফিইরা আইছে।” স্বামীহারা হাছেনাবানু বলেন, “তেতাল্লিশ বছর ধইরা আল্লাহর কাছে একটাই প্রার্থনা করছি। যারা আমাগর স্বামী-সন্তানদের নির্বিচারে হত্যা করছে, নারীর ওপরে অত্যাচার করছে, তাগর বিচার যেন অয়। মৃত্যুদণ্ড রায় বহাল থাকায় প্রমাণ অইলো যে ৩০ দিন চুরের, একদিন সাওদের। অহন তারাতারি কামরুজ্জামানের ফাঁসি কার্যকর দেইখা মরবার চাই।”

শহীদ পরিবারের সন্তান ও বিধবাপল্লীর কল্যাণ সমিতির সাধারণ সম্পাদক জালাল উদ্দিন বলেন,  ট্রাইব্যুনালে আমিসহ হাফিজা বেওয়া, করফুলি বেওয়া ও হাছেনা বানু  দেহা স্বাক্ষী দিছি। কামারুজ্জামানের নেতৃত্বে আমার বাবাসহ ১৮৭ জন গ্রামবাসীকে নির্বিচারে হত্যা করেছে। তাঁর বিরুদ্ধে ফাঁসির রায় বহাল থাকায় বিধবাপল্লির নারীসহ শহীদ পরিবারের লোকজন আনন্দিত। নালিতাবাড়ী উপজেলা মুক্তিযোদ্ধা সংসদের কমান্ডার শাহাবউদ্দিন জানান, এলাকার বিধবারাসহ মুক্তিযোদ্ধারা কামারুজ্জামানের বিরুদ্ধে মৃত্যুদণ্ড রায় বহাল থাকায় সন্তেুাষ প্রকাশ করেছে। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিাকে ধন্যবাদ জানাই। সেইসাথে এই রাজাকারের ফাঁসি কার্যকর করার দাবি জানাচ্ছি।