মধুপুর (টাঙ্গাইল) থেকে আব্দুল্লাহ আবু এহসান: ১৪ এপ্রিল মঙ্গলবার টাঙ্গাইলের ধনবাড়ীতে আবহমান বাংলার প্রাচীন ঐতিহ্যবাহী তিন দিনব্যাপী বৈশাখী মেলা শুরু হচ্ছে। এই জাঁকজমকপূর্ণ মেলা বর্ণাঢ্য উৎসবের মাধ্যমে দেশীয় সংস্কৃতির সাথে আবহমান কাল থেকেই নিবিড়ভাবে সংশ্লিষ্ট হয়ে আছে। গ্রাম বাংলার যতগুলো পুরনো ঐতিহ্য টিকে আছে তার মধ্যে অন্যতম হচ্ছে বৈশাখী মেলা।
চৈত্র বৈশাখ মাস এলেই এ মেলার ধুমধাম পড়ে যায়। চারদিকে সাজ-সাজ রব। এ মেলার মাধ্যমেই মানুষ তার পুরনো দুঃখকে ভুলে একটু আনন্দের মাধ্যমে পরবর্তী যাত্রার সূচনা করে। গরীব কৃষকেরা চৈত্রমাসে বেশি দুঃখ কষ্ট সহ্য করে। এ সময় মাঠে তেমন ফসল থাকে না, থাকে না কোনও কষ্টার্জিত অর্থ। যার ফলে এ মাসটি তারা কষ্টে কাটায়। চৈত্রের শেষ এবং বৈশাখ মাসে কৃষকেরা নতুন ফসল পায় আর তখন থেকেই তারা কিছুটা সুখের সন্ধান খুঁজে। আর মেলা তাদের কিছুটা হলেও আনন্দ যোগায়।
প্রবীণ শিক্ষক আবু মুহাম্মদ মোতাহ্হার জানান, বৈশাখী মেলার আয়োজন অনেক দিন আগেই শুরু হয়েছে। এ মেলা আয়োজনে বিশেষ একটা ঘটনা জড়িত আছে। ১৯০৬ সালে ওহাবী আন্দোলনের সময় সারা ভারতে রাষ্ট্রভাষা নিয়ে তুমুল আন্দোলন চলছে। একদিকে পাক-ভারতের মুসলিম জনগোষ্ঠীর পক্ষ থেকে উর্দুকে রাষ্ট্রভাষা ঘোষণা করার জোর দাবি উত্থাপিত হয়। অপরদিকে এ দেশের হিন্দুসমাজ ও হিন্দিকে রাষ্ট্রভাষা করার দাবি জানান। ঠিক সেই মূহুর্তে ধনবাড়ীর নবাব নওয়াব আলী চৌধুরী চুপ থাকতে পারলেন না। তিনি দেখলেন বাংলাদেশের সংখ্যা গরিষ্ঠ গরীব কৃষকের বাংলা ভাষার স্বপক্ষে কেউ কথা বলছে না। ব্রিটিশ সরকারের উচ্চ পদে থেকেও নবাব নওয়াব আলী চৌধুরী ব্রিটিশ সরকারের নিকট লিখিত দাবি উত্থাপন করেছেন।
তিনি লিখেছেন, ভারতের রাষ্ট্রভাষা কী হবে সেটা দেখার প্রয়োজন আমার নেই, যদি রাষ্ট্রভাষা পরিবর্তন হয় তাহলে বাংলার রাষ্ট্রভাষা বাংলাই করতে হবে। তিনি সর্বপ্রথম বাংলার মুসলিম নেতা, বাংলার রাষ্ট্রভাষা বাংলা করার দাবি উত্থাপন করে ছিলেন। বাংলার প্রতি অঘাত ভালোবাসার নিদর্শন স্বরূপ তিনি সেই ১৯২১ সালে বাংলা নববর্ষে ১লা বৈশাখে বৈশাখী মেলার সূচনা করেন। মেলার রূপকে প্রসারিত করার জন্য ১লা বৈশাখে পণ্যের উৎসব চালু করেন। উৎসবের সময় আগত লোকদের নবাববাড়ীর পক্ষ থেকে বিশাল আয়োজনে খাওয়ানো হতো।
এ মেলার সময় পরবী দেওয়ার প্রথা নবাব নওয়াব আলী চৌধুরী প্রবর্তন করেন। এ প্রথা ধনবাড়ী এলাকায় এখনও প্রচলন আছে। এ মেলার সময় রাজকোষ থেকে রাজ কর্মচারীদের বিশেষ ভাতা প্রদান করতেন, যাতে রাজ কর্মচারীরা তাদের পরিবার পরিজন নিয়ে আনন্দ ভরে বৈশাখী মেলা উপভোগ করতে পারেন। এ মেলার প্রধান আকর্ষণ ছিল লাঠিয়ালদের লাঠি খেলা, বেত, বাঁশ, মাটির বিভিন্ন হস্তশিল্প, কুটিরশিল্প, ম্যাজিক ও পালাগান।
লাঠি খেলার জন্য লাঠিয়ালরা বিভিন্ন এলাকা থেকে ডাক ভাঙ্গতে ভাঙ্গতে ধনবাড়ী মেলায় আসতো। এলাকার লোকজনের পহেলা বৈশাখের দিনটি আনন্দেই কেটে যেত। আজ অবধি সেই মেলা চলে আসছে। মেলার সৌন্দর্য ও আঙ্গিক বেড়ে যাওয়ায় এই বৈশাখী মেলা একদিনের পরিবর্তে তিন দিন করা হয়েছে। মেলা উৎযাপন কমিটির সভাপতি ধনবাড়ী নওয়াব ইনস্টিটিউশনের প্রধান শিক্ষক মোঃ সাইদুল ইসলাম জানান, তিন দিনব্যাপী মেলার সকল প্রস্তুতি সম্পন্ন করা হয়েছে । ১লা বৈশাখ সকাল ৮ টায় বর্ণাঢ্য র্যালির মাধ্যমে এ মেলার সূচনা হবে।