বাগেরহাট থেকে বাবুল সরদার: বাগেরহাটের ফকিরহাট উপজেলার প্রত্যন্ত গ্রামাঞ্চলে আর্সেনিকের ভয়াবহতা চরম আকার ধারণ করেছে। গভীর ও অগভীর নলকূপের তীব্র সংকট, মাঠ পর্যয়ে চিকিৎসা সেবার অপ্রতুলতা এবং গণসচেতনতার অভাবসহ নানাবিধ কারণে আর্সেনিক আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা আশাংকাজনক হারে বৃদ্ধি পাচ্ছে। দ্রুত গভীর নলকূপ স্থাপন, মাঠ পর্যায়ে চিকিৎসা সেবা প্রদানে আরো উদ্যোগী হওয়াসহ গণসচেতনতা বৃদ্ধিতে প্রচারাভিযান জরুরি বলে সংশ্লিষ্টরা মত দিয়েছেন।
১৯৯৬ সালে সর্ব প্রথম উপজেলা পিলজংগ ইউনিয়নের টাউন নওয়াপাড়া গ্রামের অনিল কুমার দাশ ও তার ছেলে শ্যামাপদ দাশ আর্সেনিক রোগে আক্রান্ত হন। সে সময় তারা ভারতের একটি হাসপাতালে চিকিৎসা গ্রহণ করতে গেলে আসের্নিক রোগ ধরা পরে। এরপর তারা পিতা পুত্র বাংলাদেশে এসে এক পর্যায়ে মারা যান। তাঁদের অনাঙ্খাকিত মৃত্যুর পর সংবাদ প্রকাশিত হলে সরকারসহ বিভিন্ন মহলে আলোড়ন সৃষ্টি হয়। এরপর সরকারসহ একাধিক সংস্থা আর্সেনিক রোগ প্রতিরোধে বিভিন্ন পদক্ষেপ গ্রহণ করে। কিন্তু উপজেলার প্রত্যন্ত গ্রামাঞ্চলের রোগীর সংখ্যা কোনও ক্রমেই কমছেনা।
স্বাস্থ্য বিভাগের সূত্র মতে, ২০১৪ সালের জরিপে উপজেলার ৮টি ইউনিয়নে মোট ১লক্ষ ৩৭হাজার ৭শত ৮৯ জন জনসংখ্যার মধ্যে ৬৬৪জন পুরুষ ও মহিলা আর্সেনিক (আর্কনোসিস) রোগে আক্রান্ত হয়েছেন। এর মধ্যে বেতাগা ইউনিয়নে ২৪জন, লখপুর ইউনিয়নে ৫৮জন, পিলজংগ ইউনিয়নে ১৭৫জন, ফকিরহাট সদর ইউনিয়নে ১১৫জন, বাহিরদিয়া-মানসা ইউনিয়নে ২৫২জন, নলধা-মৌভোগ ইউনিয়নে ১২জন, মুলঘর ইউনিয়নে ৮জন ও শুভদিয়া ইউনিয়নে ১০জন ব্যাক্তি আসের্নিক রোগে আক্রান্ত হয়েছেন।
আক্রান্ত রোগীদের উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স হতে চিকিৎসা সেবা প্রদান করার পাশাপাশি ২০১১সালের ২৭মার্চ পর্যন্ত এনজিও ফোরাম ফর ড্রিংকিং ওয়াটার সাপ্লাই অ্যান্ড স্যানেটেশন ও কোনিয়া নামক বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থা রোগীদের ওষুধ ও চিকিৎসা প্রদান করেন। এরপর তারা কোনো রোগীকে চিকিৎসা প্রদান করছেন না। যে কারনে রোগীদের চিকিৎসা সেবা ও ওষুধ পেতে নানাবিধ সমস্যা হচ্ছে।
উপজেলা জনস্বাস্থ্য প্রকৌশলী অধিদপ্তর সুত্রে জানা গেছে, উপজেলার ৮টি ইউনিয়নে ১৫শত ৫৩টি গভীর এবং ২হাজার ২শত ৩৭টি অগভীর নলকূপ রয়েছে। এর মধ্যে ১০টি গভীর ও ৮০টি অগভীর নলকূপ অকেজো রয়েছে। চাহিদার তুলনায় অনেক কম হওয়ার কারণে জনগণের প্রত্যাশা সঠিকভাবে পূরণ করা সম্ভাব হচ্ছেনা। ১০টি নলকূপ পরীক্ষা করলে প্রায় ৭টিতে আর্সেনিক পাওয়া যাচ্ছে।
সুত্রে জানা গেছে, উপজেলার মধ্যে সবচেয়ে বেশি আর্সেনিক আক্রান্ত এলাকা হিসাবে চিহিৃত হয়েছে, মানসা বাহিরদিয়া ইউনিয়নের সাতবাড়িয়া, লালচন্দ্রপুর, হুচলা, পিলজংগ ইউনিয়নের বৈলতলী, বালিয়াডাঙ্গা, বেতাগা ইউনিয়নের মাসকাটা ও লখপুর ইউনিয়নের লখপুর। আর্সেনিক রোগে আক্রান্ত শ্যামবাগাত গ্রামের মৃতঃ গহর আলীর পুত্র মুজিবুর রহমান, হাবিবুর রহমান, বালিয়াডাঙ্গা এলাকার সৈয়দ মোজাফ্ফার হোসেন, শান্ত মলি¬ক, মনোয়ারা বেগম, পারুল বেগম, সালেহা বেগম, হামিদ মলি¬ক, মাহম্মুদ মলি¬ক, ফিরুজা বেগমসহ একাধিক আক্রান্ত ব্যক্তি জানান, এই রোগে আক্রান্ত হয়ে এই গ্রামে মুনজিল মালি¬ক ও তার ভাই ইখতিয়ার মলি¬ক মারা যান। তারপর হতে একের পর এক এই রোগে আক্রান্ত হলেও স্বাস্থ্য সেবার মান উন্নয়ন বা গভীর-অগভীর নলকূপ পরীক্ষা ও নতুনভাবে নলকূপ স্থাপন করার বিষয়ে তেমন কেনো পদক্ষেপ গ্রহণ করা হচ্ছেনা।
তারা আরো অভিযোগ করে বলেন, এনজিওরা ২/৩ বছর পূর্বে ওষুধসহ চিকিৎসা সেবা প্রদান করলেও সরকারিভাবে তাদেরকে কোনো চিকিৎসাসেবা প্রদান করা হয়নি। যদি কোনো রোগী নিজের উদ্যোগে ইউনিয়ন বা উপজেলা স্বাস্থ্য কমপে¬ক্সে চিকিৎসা নিতে যায়, তবে কিছু ভিটামিন জাতীয় ওষুধ দিয়ে চিকিৎসাসেবা প্রদান করা হয়। এ ব্যাপারে বাগেরহাটের সিভিল সার্জন ডা: মো: বাকির হোসেন ও ফকিরহাট উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ কর্মকর্তা কৃষ্ণপদ লস্কার বলেন, রোগীদের সব সময় চিকিৎসাসেবা প্রদানের ক্ষেত্রে তাঁরা আন্তরিক। তাছাড়া হাসপাতালে পর্যাপ্ত পরিমানে আর্সেনিকের ওষুধ রয়েছে, যা রোগীদের চিকিৎসায় সবসময় সরবরাহ করা হচ্ছে।