বরিশাল থেকে এম.মিরাজ হোসাইন: বরিশাল বেতারের আঞ্চলিক পরিচালকের চলতি দায়িত্বে থাকা কিশোর রঞ্জন মল্লিকের বিরুদ্ধে প্রতি মাসে সরকারের লক্ষ লক্ষ টাকা আত্মসাতসহ অসংখ্য অভিযোগ উঠেছে। বেতারের কর্মকর্তা কর্মচারীরা এসব ব্যাপারে একাধিক লিখিত অভিযোগ দিয়েছেন মহাপরিচালকের কাছে। সর্বশেষ তার অর্থ আত্মসাত বিষয়ে ইঙ্গিত দিয়ে মহাপরিচালক এবং অতিরিক্ত মহাপরিচালকের কাছে চিঠি দিয়েছেন বরিশালে বেতারের উপ-আঞ্চলিক প্রকৌশলী নিত্য প্রকাশ বিশ্বাস। আঞ্চলিক পরিচালকের চলতি দায়িত্বে থাকা কিশোর অবশ্য এসব অভিযোগ স্বীকার করেননি। এসব তার বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র বলে দাবি করেছেন তিনি।
১৯৯৯ সালে বরিশাল বেতারে সহকারী পরিচালক পদে যোগ দেন কিশোর রঞ্জন মল্লিক। টানা পাঁচ বছর চাকুরি করার পর তাকে বদলি করা হয় রংপুর বেতারে। সেখান থেকে উপ-পরিচালক হিসেবে ২০০৭ সালে আবার ফেরেন বরিশাল বেতারে। এরপর গত ৮ বছর ধরে আছেন এখানে। ৭/৮ মাস আগে পান আঞ্চলিক পরিচালকের চলতি দায়িত্ব। এরপর থেকেই তার বিরুদ্ধে উঠতে থাকে একের পর এক দুর্নীতির অভিযোগ। যেসব অভিযোগের সাথে জড়িয়ে যায় লক্ষ লক্ষ টাকার হাতবদল। কিছুদিন আগে এসব বিষয় নিয়ে বেতারের মহাপরিচালকের কাছে চিঠি দেন খোদ বেতারেরই কর্মকর্তা-কর্মচারীরা। সেই চিঠিতে দেওয়া হয় তার দুর্নীতির নানা ফিরিস্তি।
মহাপরিচালক বরাবর দেওয়া ওই চিঠিতে কিশোর রঞ্জন মল্লিকের বিরুদ্ধে তোলা হয় ভুয়া রেকর্ডিং দেখিয়ে লক্ষ লক্ষ টাকা আত্মসাতের অভিযোগ। ইউনিসেফে’র একটি প্রকল্প এবং বেতার স্টেশনের জন্য গাড়ি ভাড়াসহ আরো বেশ কয়েকটি খাতে বিপুল অংকের অর্থ আত্মসাতেরও অভিযোগ আনা হয় তার বিরুদ্ধে। এসব অভিযোগে বলা হয়, বরিশাল বেতারে প্রচারিত অনুষ্ঠানসমূহের অধিকাংশই পুনঃপ্রচারিত। অথচ কিশোর প্রতিমাসে নতুন রেকর্ডিং দেখিয়ে উত্তোলন করেন লাখ লাখ টাকা। একই ঘটনা ঘটে জারিগান রেকর্ডিংসহ প্রায় সকল অনুষ্ঠানের ক্ষেত্রে। গানের প্রস্তাবনা খাতা, বিল, রেকর্ডিং, লগ, কম্পিউটার, সিডি, টেপচার্ট এবং কিউশিট দেখলেই এসব অভিযোগের প্রমান মিলবে বলে বলা হয় ওই অভিযোগে।
স্টেশনের জন্য ভাড়া করা গাড়ির ক্ষেত্রে টেন্ডারে যে গাড়ির উল্লেখ ছিল তা না নিয়ে অপেক্ষাকৃত নি¤œ মানের একটি গাড়ি ব্যবহার করারও অভিযোগ আনা হয়েছে তার বিরুদ্ধে। এক্ষেত্রে নি¤œমানের গাড়ি নিয়ে গাড়ি সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠানের কাছ থেকে অনৈতিক সুবিধা নেওয়ার অভিযোগ করা হয় তার বিরুদ্ধে। বেতারের ৩টি বিভাগের কর্মকতা-কর্মচারীদের ব্যবহার এবং বহিরাঙ্গণ অনুষ্ঠানের জন্য এই গাড়ি চলাচলের কথা থাকলেও অন্যদের গাড়ি না দিয়ে তার পরিবারের সদস্যদের গাড়ি ব্যবহারেরও অভিযোগ করা হয়েছে তার বিরুদ্ধে। সেই সঙ্গে রয়েছে গাড়ি ব্যবহারের ভুয়া বিল দাখিল করে অর্থ আত্মসাতের অভিযোগ।
মহাপরিচালক বরাবর করা এসব অভিযোগের সত্যতা মেলে গত ৩ মাসে বরিশালের হিসাব রক্ষণ (এজি) অফিস থেকে বেতারের নামে বরাদ্ধ হওয়া মাসিক বিলের বিশ্লেষণে। ফেব্রুয়ারি মাসে রঞ্জন কুমার মল্লিকের দেওয়া একটি চিঠির সূত্রে পাওয়া তথ্যানুযায়ী তিনি নিজেই প্রকৌশল বিভাগকে জানান যে, হরতাল অবরোধের কারণে জানুয়ারি মাসে কোনো গাড়ি ব্যবহার হয়নি। এছাড়া ফেব্রুয়ারি মাসে গাড়ি ব্যবহার হয়েছে মাত্র ৫/৬ দিন। অথচ এজি অফিসে বিল দাখিলের ক্ষেত্রে জানুয়ারি এবং ফেব্রুয়ারি মাসে গাড়ি ব্যবহার দেখিয়ে পুরো ১ লাখ টাকা তুলে নেন কিশোর রঞ্জন মল্লিক।
গত ৮ এপ্রিল বরিশাল বেতারের প্রকৌশল বিভাগের আঞ্চলিক পরিচালকের দায়িত্বে থাকা নিত্য প্রকাশ বিশ্বাস মহাপরিচালকে দেওয়া একটি চিঠিতেও স্পষ্ট উল্লেখ করেন বিষয়টি। পরিচয় গোপন রাখার শর্তে বেতারের একাধিক কর্মকর্তা কর্মচারী জানান, কিশোর রঞ্জনকে অফিসে নামিয়ে দিয়েই স্টেশন থেকে বেড়িয়ে যায় গাড়ি। এরপর তা ব্যবহার হয় তার স্ত্রী সন্তানদের নানা প্রয়োজনে। স্টেশনের গেটে থাকা সিসি ক্যামেরার ফুটেজ পরীক্ষা করলেই এর প্রমান পাওয়া যাবে। তার এ ধরনের কর্মকান্ডের কারণে বিভিন্ন সময়ে বহিরাঙ্গণ অনুষ্ঠানে বেতারের লক্ষ লক্ষ টাকার যন্ত্রাংশ অনুষ্ঠানস্থলে নিতে হয় ব্যাটারিচালিত অটোরিক্সায় চরম নিরাপত্তাহীনভাবে।
বাংলাদেশ বেতারের সাথে ইউনিসেফ’র হওয়া একটি চুক্তি অনুযায়ী বিশেষ প্রকল্প বাস্তবায়নের ক্ষেত্রেও দুর্নীতির অভিযোগ করা হয়েছে কিশোর রঞ্জন মল্লিকের বিরুদ্ধে। বেশ কয়েকটি এনজিও’কে সাথে নিয়ে প্রায় ১১ লাখ টাকা ব্যয়ে সম্পন্ন হওয়া ওই প্রকল্পে প্রশিক্ষণ, ওরিয়েন্টশন এবং অনুষ্ঠান দেখিয়ে তিনি লাখ লাখ টাকা আত্মসাত করেছেন বলে অভিযোগ বেতারেরই উল্লেখযোগ্য সংখ্যক কর্মকর্তা-কর্মচারীর। এছাড়া বেতার শ্রোতা ক্লাবের নামে বরাদ্দ হয়ে আসা সোলার রেডিও আত্মসাতেরও অভিযোগ রয়েছে তার বিরুদ্ধে।
পরিচয় গোপন রাখার শর্তে বেতারের প্রকৌশল বিভাগের একজন কর্মকর্তা বলেন, ‘মল্লিকের এসব কর্মকান্ডের প্রতিবাদ করতে গেলেই নানাভাবে ভয়ভীতি প্রদর্শনসহ হয়রানি, হেনস্থা করেন তিনি। বাড়ি গোপালগঞ্জে হওয়ায় সর্বপ্রথম ভয় দেখান প্রধানমন্ত্রীর এলাকার লোক হিসেবে। একইসাথে চলে মহাপরিচালকের নাম ভাঙ্গিয়ে ভয়-ভীতি প্রদর্শন এবং স্থায়ী কর্মকর্তা-কর্মচারীদের দূরবর্তী স্টেশনে বদলি ও অস্থায়ী কর্মচারীদের চুক্তি বাতিলের ভয় দেখানো।’
এসব বিষয় নিয়ে গণমাধ্যমের সাথে আলাপকালে শুরুতেই সব অভিযোগ অস্বীকার করে তিনি বলেন, ‘টেন্ডারে প্রদর্শিত গাড়িটি বিকল হওয়ায় সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠান অন্য একটি গাড়ি দিয়েছে। চুক্তি অনুযায়ী গাড়ি দেওয়ার জন্য তাদেরকে চিঠি দেওয়া হয়েছে।’ স্টেশনের গেটে থাকা সিসি ক্যামেরার ফুটেজ অনুযায়ী আপনি আগাগোড়া এই গাড়ি-টিই ব্যবহার করছেন বলা হলে তিনি অবশ্য কোনো সদুত্তর দিতে পারেননি। একইভাবে সদুত্তর দিতে পারেননি ব্যবহার না করেও গাড়ি ভাড়া বাবদ লাখ টাকা বিল উত্তোলন বিষয়ে। কেবল বলেন, অতিরিক্ত যে টাকা গাড়ি সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠানকে দেওয়া হয়েছে তা ফেরত চেয়ে চিঠি দেওয়া হবে। এছাড়া তার বিরুদ্ধে উত্থাপিত প্রায় সকল অভিযোগই অস্বীকার করেন তিনি।
ইউনিসেফ’র প্রকল্প বিষয়ে বলেন, ‘এই কাজটি আমি একা করিনি। এর সাথে ৪টি উপজেলার একাধিক এনজিও সংশ্লিষ্ট ছিল। ব্যয়ের যাবতীয় রেকর্ড রয়েছে আমাদের কাছে।’ মহাপরিচালকের নাম ভাঙ্গিয়ে ভয়-ভীতি প্রদর্শন এবং পূনঃপ্রচারিত অনুষ্ঠানকে নতুন দেখিয়ে বিল তোলাসহ অন্যান্য সকল অভিযোগ অস্বীকার করে তিনি বলেন, ‘আঞ্চলিক পরিচালকের চলতি দায়িত্বে আসার পর বরিশাল বেতারে থাকা সকল অনিয়ম দুর্নীতি দূর করে এখানে একটি সুস্থ পরিবেশ এনেছি। এ কারনে একটি সুবিধাভোগি চক্র আমার উপর ক্ষিপ্ত। তারাই এসব অপপ্রচার চালাচ্ছে।