রাজধানী ঢাকাসহ সারাদেশে ভূমিকম্প, আতঙ্ক

রাজধানী ঢাকা, রাজশাহী, দিনাজপুর, রংপুর, খুলনা, কুষ্টিয়া, ময়মনসিংহ, নেত্রকোনা, শেরপুর, ঝিনাইদহ, লক্ষ্মীপুর, দিনাজপুর, পটুয়াখালী, গাইবান্ধাসহ দেশের বিভিন্ন জায়গায় শনিবার দুপুরে পর পর কয়েক দফা ভূমিকম্প অনুভূত হয়েছে।

বাংলাদেশে রাজধানীসহ দেশের বিভিন্নস্থানে বেশ কয়েক সেকেন্ড স্থায়ী ভূমিকম্পের সময় আতঙ্কে লোকজন ঘরবাড়ি ছেড়ে রাস্তায় নেমে আসে।

বাংলাদেশ আবহাওয়া অধিদপ্তরের ভূমিকম্প পর্যবেক্ষণ কেন্দ্র জানায়, শনিবার বাংলাদেশ সময় দুপুর ১২টা ১১ মিনিট ২৭ সেকেন্ড এ ভূমিকম্প অনুভূত হয়। ভূমিকম্পের উৎপত্তিস্থল ঢাকা থেকে ৭৪৫ কিলোমিটার দূরে, নেপালে। এ ভূমিকম্পের তীব্রতা ছিল ৭ দশমিক ৫ মাত্রা। এর পর পরই ৬ দশমিক ৪ তীব্রতার আরেকটি ভূমিকম্প হয়েছে। এক ঘণ্টার ব্যবধানে পাঁচ দফায় ভূমিকম্প অনুভূত হয়েছে ঢাকাসহ সারা দেশে। সবকটি ভূমিকম্পেরই উৎপত্তিস্থল ছিলো নেপাল।

ইউএসজিএ জানায়, প্রথম ভূমিকম্পটি অনুভূত হয় বাংলাদেশ সময় বেলা ১২টা ১৩ মিনিটে। এই ভূমিকম্পের কেন্দ্রস্থল ছিলো নেপালের পোখরায়। সেখানে রিখটার স্কেলে মাত্রা ছিলো ৭.৯। বাংলাদেশে তা অনুভূত হয় ৭.৫ মাত্রায়। একই মাত্রায় ভারতকে কাঁপিয়ে তোলে ওই প্রথম ভূমিকম্পটি।

এর কিছুক্ষণের মধ্যেই শুরু হয় ভূমিকম্পের পরাঘাত (আফটার শক)গুলো। প্রথম ভূমিকম্পের ১৭ মিনিটের মধ্যে ৫.৪ মাত্রার একটি কম্পন অনুভূত হয় বাংলাদেশে। এরপর ৭ মিনিট পর আরেকটি ভূমিকম্প অনুভূত হয় যাত্রা মাত্রা ছিলো ৬.৫। আর তার প্রায় ১০ মিনিট পরে বাংলাদেশ সময় ১২টা ৫৮ মিনিটে চতূর্থ কম্পনটি অনুভুত হয়। যার মাত্রা ছিলো ৫.৮। আর পঞ্চম ভূমিকম্পটি হয় বাংলাদেশ সময় বেলা ১টা ১৫ মিনিটে। যার মাত্রা ছিলো ৫.২।

সারাদেশে তাৎক্ষণিক ক্ষয়ক্ষতি, হতাহত
ভূমিকম্পে রাজধানীর মিরপুরে ডায়মন্ড গার্মেন্টস নামের একটি পোশাক কারখানা ও বংশালে ছয়তলা একটি ভবন কিছুটা হেলে পড়েছে বলে ফায়ার সার্ভিসের নিয়ন্ত্রণকক্ষ থেকে জানানো হয়েছে। ফেনীর অতিরিক্ত পুলিশ সুপার সাইফুল হক জানান, ফেনী শহরের শহীদ শহীদুল্লাহ কায়সার সড়কে শাহ আলম টাওয়ার নামের একটি ১০তলা বাণিজ্যিক ভবনে ফাটল দেখা দিয়েছে। ভবনটি সিলগালা করে দিয়েছে ফায়ার সার্ভিস।

সাভারের একটি তৈরি পোশাক কারখানায় ভূমিকম্পের আতঙ্কে তাড়াহুড়ো করে নামতে গিয়ে এক শ্রমিক নিহত হয়েছেন। এতে আহত হয়েছেন শতাধিক শ্রমিক। আহত ২০ জনের অবস্থা গুরুতর বলে জানিয়েছেন চিকিৎসকরা। সাভারের কর্নপাড়া এলাকায় আল মুসলিম গ্রুপের বহুতল তৈরি পোশাক কারখানায় এ ঘটনায় ঘটে।

ভূমিকম্পে ময়মনসিংহ শহরের গাঙ্গিনার পাড় এলাকায় ‘অলকা নদী বংলা’ নামের একটি বহুতল ভবন সামান্য হেলে পড়েছে। এতে একটি বিপণিকেন্দ্র রয়েছে। ময়মনসিংহ ফায়ার সার্ভিসের সহকারী পরিচালক আবুল হোসেনের ভাষ্য, ভূমিকম্পের সময় ভালুকা উপজেলার ঢাকা-ময়মনসিংহ সড়কের বেশ কয়েকটি পোশাক কারখানার শ্রমিকেরা আতঙ্কে মহাসড়কে নেমে আসেন।

শেরপুর জেলা সদরসহ পাঁচ উপজেলায় পর পর দু’দফায় ভূমিকম্পের আতংকে শহরের স্কুলগুলো ছুটি দেওয়া হয়েছে। প্রথমবার দুপুর ১২ টা ১৫ মিনিটের সময় প্রায় ৪৭ সেকেন্ড স্থায়ী ভূমিকম্প অনুভূত হয়েছে। এ সময় বড় আকারের দু’টি কম্পন অনুভূত হয়। এ সময় ভূমিকম্পে ঘরবাড়ি, গাছপাল, পুকুরের পানি হেলতে-দুলতে থাকায় মানুষজন প্রাণভয়ে ঘর থেকে বাইরে বেড়িয়ে আসে। সাধারণ মানুষের মাঝে আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ে।  প্রায় আধাঘন্টার ব্যবধানে পর পর দু’দফা ভুমিকম্প হওয়ায় শহরের শিশু শিক্ষার্থীদের মধ্যে ভয়-আতংক দেখা দেওয়ায় সরকারি-বেসরকারি স্কুলগুলো ছুটি দেওয়া হয়। তবে এ রিপোর্ট লেখা পর্যন্ত (বেলা আড়াইটা) কোন ক্ষয়ক্ষতির সংবাদ পাওয়া যায়নি।

ঈশ্বরদীতে নির্মাণাধীন রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্রে গবেষক ড: রজব আলী জানান, এই ভূকম্পন ছিল রিখটার স্কেলে ৪ মাত্রার।  ঈশ্বরদী ইপজেড-এর জাপানি প্রতিষ্ঠান নাকানো ইন্টারন্যাশনাল ও চীনা প্রতিষ্ঠান এমজিএল লিমিটিডের দু’টি ভবনে ফাটল দেখা দিয়েছে। ২য় দফায় ভূমিকম্পের সময় আতঙ্কগ্রস্ত শ্রমিকরা হুড়োহুড়ি করে নামতে যেয়ে এই দু’টি প্রতিষ্ঠানের শতাধিক আহত হয়। ঈশ্বরদী উপজেলা হাসপাতালে ৭০ জন ছাড়াও অন্যান্য আহতদের ইপিজেডের চিকিৎসা কেন্দ্র, পার্শবর্তী ভেড়ামারা হাসপাতাল ও বেসরকারি হামপাতালে চিকিৎসা দেওয়া হয়। ইপজেডের জিএম রুহুল আমিন জানান, নাকানোর ভবনে ফাটল আতঙ্কে অসুস্থ শ্রমিকদের চিকিৎসা দেওয়া হয়েছে। অসুস্থ শ্রমিকদের বেশিরভাগই নারী।

এছাড়া ঈশ্বরদী মহিলা কলেজ কেন্দ্রে অনুষ্ঠিত ২য় বর্ষের অনার্স পরীক্ষার্থীরা ভূকম্পনের সময় আত্ম চিৎকার করে পরীক্ষার হল থেকে বেরিয়ে আসে। এ সময় ১২ জন পরীক্ষার্থী অসুস্থ হয়ে পড়ে। পরে ভূকম্পন থেমে গেলে আবারো পরীক্ষার হলে বসলেও অনেকেই আতংকের কারণে স্বাভাবিক হতে পারেনি বলে জানিয়েছেন পরিদর্শক প্রভাষক ইসমাইল হোসেন। সুপ্রাচীন রেলওয়ে চন্দ্রপ্রভা বিদ্যাপিঠের প্রধান শিক্ষক দেবদাস স্যান্নাল জানান, প্রাচীন এই স্কুল দীর্ঘদিন সংস্কার না করায় জ্বরাজীর্ণ । ভূমিকম্পের সময় সময় পুরাতন ভবন ভীষণভাবে কাঁপতে থাকে। এ সময় ছাত্র-ছাত্রীদের মধ্যে আতংক ছড়িয়ে পড়লে অনেকেই কান্নাকাটি ও আর্তচিৎকার করতে থাকে। ঈশ্বরদী শহরে ব্যবসায়ীরা প্রাণভয়ে দোকানপাঠ ফেলে রাস্তায় নেমে আসে। এ সময়  আরো ৮ জন মাথা ঘুরে অসুস্থ হয়ে পড়ে বলে জানা যায়।

দিনাজপুরে ভূমিকম্পে আতঙ্কে লোকজন ঘর-বাড়ি ছেড়ে বাহিরে বের হয়ে আত্মরক্ষা করেছে। দিনাজপুরের শহরসহ বিভিন্ন এলাকায় ভূকম্পন অনুভুত হয়। তীব্র ভূকম্পনে মানুষজন বাড়ি-ঘর, দোকানপাট থেকে প্রাণ ভয়ে রাস্তায় বের হয়ে আসেন। এসময় আজানের ধ্বনি শোনা যায়। তবে কোথাও কোন ক্ষয়ক্ষতি হয়নি। দ্বিতীয় দফা ১২টা ৪৮ মিনিটে মৃদু ভূকম্পন হয়।
প্রথম দফা ভূকম্পনের সময় আত্মরক্ষার জন্য নিরাপদ আশ্রয়ের সন্ধানে মানুষজন ছুটোছুটি করে। স্কুলের শিশুরা ক্লাস রুম থেকে বের হয়ে মাঠে জড়ো হয়।
এ ব্যাপারে দিনাজপুর আবহাওয়া অধিদপ্তরের কর্মকর্তা আশিকুর রহমানের নিকট জানতে চাওয়া হলে তিনি জানান, ভুমিকম্পনের বিষয় তিনি নিজেও অবগত আছেন। তবে তার অফিসে ভুমিকম্পন পরিমাপ মেশিন না থাকায় কতক্ষণ ভুমিকম্পন হয়েছে তা রেকর্ড করতে পারেনি।

দেশ কাঁপানো ভূমিকম্পে শিল্প নগরী খুলনাতেও আতংক সৃষ্টি করেছে। খুলনায় বেশ কিছু স্থানে ভবনে ফাটল, দেবে যাওয়া ও হেলে পড়ার খবর পাওয়া গেছে। সারা দেশের ন্যায় খুলনা বিভাগের ১০জেলার বিভিন্ন এলাকায় মৃদু, মাঝারি ও বড় ধরণের ভূকম্পন অনুভূত হয়।

প্রায় মিনিট খানেক স্থায়ী এ ভূকম্পনের মধ্যে নগরীর দাদা ম্যাচ ফ্যাক্টরীর পাশে ইব্রাহীম নামের একজনের পাঁচতলা একটি ভবনের নিচতলা দেবে গেছে, হেলাতলা মোড়ের একটি চারতলা ভবন, পিকচার প্যালেস মোড়ে আজমল প্লাজা হেলে পড়েছে। একইভাবে বড় বাজারের একটি ভবন হেলে পড়েছে। এছাড়া মহানগর বিএনপি কার্যালয়ের পাশের একটি ভবনে ফাটল দেখা গেছে। তবে এতে কেউ হতাহত হয়নি। এসময়ে নগরীর বিভিন্ন এলাকায়, অলি-গলিতে সাধারণ মানুষ বাসা ছেড়ে রাস্তায় বেরিয়ে আসে। অনেক অফিস, দোকানপাট, মার্কেট থেকেও লোকজন আতংকে রাস্তায় চলে আসে ।

এ বিষয়ে খুলনা আবহাওয়া অফিসের সিনিয়র আবহাওয়া কর্মকর্তা আমিরুল আজাদ দুপুর সাড়ে ১২টায় বলেন, ভূমিকম্পন হয়েছে। তবে এ মূহুর্তে আমার কাছে পরিসংখ্যানগত কোন তথ্য নেই।

KALAPARA PIC-1(25.04.15)JOLKOMPON
কলাপাড়ায় পুকুরের পানিতে অস্বাভাবিক ঢেউয়ের সৃষ্টি হলে শিক্ষার্থীরা দেখার জন্য শ্রণিকক্ষ থেকে বেড়িয়ে আসে

কলাপাড়া উপজেলার সর্বত্র মৃদু ভূমিকম্প অনুভূত হয়েছে। আকস্মিক ভূমিকম্পে জলকম্পনের কারণে কুয়াকাটা বঙ্গোপসাগর ও বিভিন্ন নদীতে অস্বাভাবিক জোয়ার ও উত্তাল ঢেউ সৃষ্টি হয়। এ সময় পুকুরের পানিতে অস্বাভাবিক ঢেউয়ের সৃষ্টি হলে হাজার হাজার মানুষ ঘর ছেড়ে বাইরে বেড়িয়ে পড়ে। শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীরা আতঙ্কিত অবস্থায় শ্রেণিকক্ষ ছেড়ে বাইরে বেরিয়ে আসে। সাগর হঠাৎ করে উত্তাল হয়ে উঠায় সাগরে যাত্রা করা ট্রলারের জেলেরা উপকূলে ফিরে আসে। কুয়াকাটা সৈকতে ভ্রমনে আসা পর্যটকরা তীরে আশ্রয় নেয়। তবে ২০ মিনিট পর ঢেউয়ের তান্ডব কমে যাওয়ায় পরিস্থিতি শান্ত হয়। কোন ক্ষয়ক্ষতির খবর পাওয়া যায়নি।