মধুপুর (টাঙ্গাইল) থেকে আব্দুল্লাহ আবু এহসান: বাংলাদেশ, নেপাল, ভারত, মায়নমারসহ ভারতীয় উপমহাদেশে বড়সড় ভূমিকম্প হলেই সর্বাগ্রে চলে আসে প্লাইস্টোসিন সোপান মধুপুর ভূকম্পন বলয়ের নাম। দেশের তিনটি ভূমিকম্পের ফাটলরেখার (ফল্ট) মধ্যে একটির অবস্থান মধুপুর গড় অঞ্চলে হওয়ায় এলাকাটি ভূমিকম্পের ঝুঁকিতে রয়েছে। শনিবার (২৫ এপ্রিল) নেপালে ৭.৯ মাত্রার এবং রবিবার (২৬ এপ্রিল) ভূমিকম্প আঘাত হানায় মধুপুরসহ বাংলাদেশেও এর প্রচন্ড ঝাঁকুনি অনুভূত হয়। ২০০৯ সালে বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রকৌশল বিভাগের অধ্যাপক ড. মেহেদী আহমেদ আনসারীর নেতৃত্বে পরিচালিত ইউএনডিপির গবেষণা থেকে জানা যায় বাংলাদেশের ভূকম্পন বলয়সমূহ বিশেষ করে প্লাইস্টোসিন বা মহাহিম যুগে সৃষ্টি মধুপুর ফল্ট বিপজ্জনক।
রাজধানী ঢাকা থেকে মধুপুর ফল্টের দুরুত্ব মাত্র ৬০ থেকে ৯০ কি.মি. হওয়ায় আলোচনায় সর্বাধিক গুরুত্ব পাচ্ছে মধুপুর ফল্ট নিয়ে। মধুপুর ফল্ট রাজধানী ঢাকার খুব কাছে হওয়ায় রাতের বেলায় ৭ থেকে ৭ দশমিক ৫ মাত্রার ভূমিকম্প হলে শুধুমাত্র ঢাকা শহরেই হতাহত হবে ৯০ হাজার লোক। আর দিনের বেলায় আঘাত হানলে হতাহত হবে ৭০ হাজার লোক। এতে ৭২ হাজার ভবন সম্পূর্ণরূপে এবং ৮৫ হাজার ভবন আংশিক ক্ষতিগ্রস্ত হবে।
১৯১০ সালে ভারতীয় উপমহাদেশের ভূমিকম্প বিষয়ক গবেষণায় ভূগোলবিদ ডিলাটিসে বাংলাদেশ প্রসঙ্গে বলেন, মহাহিম যুগে সৃষ্টি হয়েছে এই মধুপুর গড়ের। তার মতে এটি ভূকম্পন এলাকাভুক্ত বিপজ্জনক এলাকা। ভুগোলবিদ এফসি হাস্ট তার মতকে সমর্থন করেছেন। মধুপুর বিশ্ববিদ্যালয় কলেজের অধ্যাপক জয়নাল আবেদীন জানান, নেপালে গত ২৫ এপ্রিলের এবং গতকালের ভূমিকম্পনের ফলে মধুপুর ফল্টের পরিবর্তন আসার সম্ভবনা রয়েছে। ফলে এখানকার প্লেট বা সাবপ্লেট বিচ্যুত হলো কি না তা পর্যবেক্ষণ করা খুবই জরুরি। অন্যদিকে দীর্ঘদিন ধরে মধুপুর ভূবলয়ের বিপজ্জনক কেন্দ্র নিয়ে গবেষণা করে বিশেষজ্ঞরা রাজধানী ঢাকা থেকে এর দুরত্ব ৬০ থেকে ৯০ কি.মি. বলে উল্লেখ করেছেন। তবে এ দূরত্ব নির্ণয় নিয়েও বিশেষজ্ঞদের মধ্যে মতভেদ রয়েছে।
মধুপুর অঞ্চলের ফল্ট নিয়ে দেড় দশক ধরে কাজ করছে বেসরকারি সংস্থা ওয়ার্ল্ডভিশন। ওয়ার্ল্ডভিশনের মধুপুর শাখার ম্যানেজার বাপন মানকিন বলেন সারা দেশকে যে তিনটি ভূকম্পন বলয়ে বিভক্ত করা হয়েছে তার মধ্যে মধুপুর জোন ২য়। মধুপুর ফল্টের ভূমিকম্পের জন্য শুধু রাজধানী ঢাকা নয়, ভূচ্যুতির থাবার মুখে অবস্থিত মধুপুর গড়াঞ্চলের টাঙ্গাইল, মংমনসিংহ এবং গাজিপুরে ব্যাপক ধ্বংসযজ্ঞ ও ক্ষয়ক্ষতির সম্মুখীন হবে। রাজধানীর বাইরে শহরায়ন ও শিল্পায়ন হওয়ায় ভূমিকম্পের ক্ষয়ক্ষতি নিরূপণে আরো সতর্ক হতে হবে। তিনি আরো বলেন, ভূমিকম্প সম্পর্কে সচেতন করে তোলার জন্য ওয়ার্ল্ডভিশন মধুপুর উপজেলার প্রত্যেক ইউনিয়নে ২০ সদস্যের একটি প্রশিক্ষিত স্বেচ্ছাসেবক দল গঠন করেছে। জয়েনশাহী আদিবাসী উন্নয়ন পরিষদের সভাপতি ইউজিন নকরেক বলেন, আমরা মধুপুর গড়ে বসবাসকারীরা ভূমিকম্প নিয়ে খুবই আতঙ্কিত। কেননা ভূমিকম্পের ফলে যদি ভূমিধস ঘটে তাহলে আমরা তো চাপা পড়বোই, আমাদের ভূমিও হারিয়ে যেতে পারে।
ভূগোলবিদ মর্গান এবং ম্যাকিটায়ারের মতে, ভূকম্পন এবং বিপর্যয়ের ফলে একটি বিদ্যমান অববাহিকা থেকে মধুপুরের গড়ের মত উঁচু ভূমির সৃষ্টি হয়েছে। এর মৃত্তিকার স্তরায়নের এখনো শেষ হয়নি। এজন্য ভূকম্পনের দিকে থেকে মধুপুর গড় বেশি মাত্রায় ঝুঁকিপূর্ণ। ( তথ্যসূত্র টাঙ্গাইল ডিস্ট্রিক্ট গেজেটিয়ার ১৯৮৩)।
সুতরাং ভূস্তরে মধুপুর টেকটোনিক বলতে যা বোঝায় তা শুধু মধুপুর উপজেলাকে বোঝায় না বরং মধুপুর গড়ের পুরো এলাকাকে বোঝায়। আর এ ভূচ্যুতি ঢাকার কাছে হওয়ায় এখানে ভূমিকম্প হলে রাজধানী ঢাকার খুব বেশি ক্ষয়ক্ষতি হবে। মধুপুর শহীদ স্মৃতি কলেজের অধ্যক্ষ বজলুর রশীদ চুন্নু জানান, ভূমিকম্প পর্যবেক্ষণের জন্য মধুপুরে একটি সাইসমোগ্রাফ রয়েছে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভূতত্ত্ব বিভাগ এটি পরিচালনা করছে। কিন্তু এখানে সার্বক্ষণিক কোন লোক থাকেনা। বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বিশেষজ্ঞরা মাঝে মধ্যে এসে দেখে যান। তিনি আরো বলেন, সাইসমোগ্রাফের ফলাফল কী হয় তা জানতে পারলে আমরা হয়তো আশঙ্কামুক্ত থাকতে পারি।