কুয়াকাটার সাগরে অবাধে নিধন হচ্ছে বিরল প্রজাতির কাঁকড়া

মিলন কর্মকার রাজু, কলাপাড়া(পটুয়াখালী): কুয়াকাটাসংলগ্ন বঙ্গোপসাগরে জেলেদের সুক্ষ্ম ফাঁসে জালে ধরা পড়ছে বিরল প্রজাতির ফ্লাওয়ার কাঁকড়া। গত এক সপ্তাহ ধরে হাজার হাজার ফ্লাওয়ার কাঁকড়া ধরা পড়ছে। তবে বিক্রি করতে না পেরে জেলেরা এগুলোকে পিষে শুকিয়ে মাছের খাদ্য তৈরি করছে।

নীল অমৃত কাঁকড়া বা স্যান্ড কাঁকড়া (বৈজ্ঞানিক নাম: Portunus pelagicus নামে এ কাঁকড়া পরিচিত। তবে স্থানীয়রা এটাকে টাইগার কাঁকড়া নামে চেনেন।

বিরল প্রজাতির এ কাঁকড়া রক্ষা ও নিধন রোধে জরুরি উদ্যেগ নেয়ার দাবি জানিয়েছে পর্যটকসহ পরিবেশবিদরা।

flower crab

হালকা বাদামি রঙের এ কাঁকড়ার খোলসে চিতা বাঘের মতো কালো ছাপ রয়েছে। খোলসের দু পাশে নিজেদের রক্ষার জন্য এক ইঞ্চি দীর্ঘ দুটি হুল রয়েছে। মা কাঁকড়ার দেহ হালকা হলুদ বা হালকা বাদামি। কুয়াকাটায় ধরা পড়া কাঁকড়াগুলো ব্লু-সুইমার কাঁকড়ার পুরুষ জাতের বলে জানা গেছে।

কলাপাড়া মৎস্য বিভাগ জানায়, বাংলাদেশে বিভিন্ন প্রজাতির কাঁকড়া দেখা গেলেও ফ্লাওয়ার কাঁকড়া বা টাইগার কাঁকড়া দেখা গিয়েছিলো প্রায় অর্ধশত বছর আগে। এ জাতের কাঁকড়া ভারত মহাসাগর ও ভূ-মধ্য সাগরের উপকূলসহ আফ্রিকা, দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া, অস্ট্রেলিয়া, পারস্য সাগর উপকূলে দেখা গেলেও বাংলাদেশে এ কাঁকড়া এখন আর দেখা যায় না। তবে সুন্দরবনের কিছু এলাকায় এ মৌসুমে কিছু কাঁকড়া দেখা যায়।

সূত্রটি আরো জানায়, মার্চ থেকে আগস্ট মাসের মধ্যে ফ্লাওয়ার কাঁকড়া সমুদ্রে ডিম ছাড়ার জন্য উপকূলের কাছাকাছি চলে আসে। ডিমের লার্ভাগুলো সাগরের জোয়ারের তোড়ে উপকূলে চলে আসে। গভীর সমুদ্রে ডিম ছাড়ার কারণে প্রাপ্তবয়স্ক হওয়ার আগ পর্যন্ত ছোট কাঁকড়াগুলো উপকূলের কাছেই বিচরণ করে। এগুলো ১৮-২৪ মাসের মধ্যে প্রাপ্তবয়স্ক হয়। একটি প্রাপ্তবয়স্ক কাঁকড়ার ওজন ৩৫০ গ্রাম-৬০০ গ্রাম পর্যন্ত হয়।

কুয়াকাটা সৈকত ঘুরে দেখা যায়, সৈকতের অন্তত দশটি পয়েন্টে গত এক সপ্তাহ ধরে শতশত শ্রমিক এ কাঁকড়া শুকানোর কাজ করছে। প্রতিদিন কয়েকটি গ্রুপে ভাগ হয়ে তারা কাঁকড়া শিকার করছে।

নারকেল বাগানে কাঁকড়া শুকানোর কাজ করছিলেন জেলে মো. সোহেল। তার নেতৃত্বে অন্তত ৩০ শ্রমিক কাঁকড়া শুকাচ্ছে। তিনি জানালেন, সাগরের দু-তিন কিলোমিটারের মধ্যে খুটা জেলেদের জালে এ কাঁকড়া বেশি ধরা পড়ছে। জালে অন্য মাছের সাথে ছোট ছোট এই কাঁকড়া বেশি ধরা পড়ায় তা বাছাইয়ের কাজ করছে ১০-১৫ শ্রমিক। মাছ থেকে এই কাঁকড়া আলাদা করে মাছ বিক্রি করলেও এই কাঁকড়া বিক্রি না হওয়ায় তা পিষে শুকিয়ে মাছের খাদ্য তৈরি করছে। স্থানীয় বাজারে প্রতিমণ শুকনো কাঁকড়ার গুঁড়া ১ হাজার ১০০ টাকায়  বিক্রি হচ্ছে।

crab processing
পায়ে পিষে কাঁকড়া দিয়ে মাছের খাবার তৈরির কাজ চলছে।

কাঁকড়া বাছাইয়ের কাজে নিয়োজিত ষাটোর্ধ্ব আকলিমা বেগম বলেন,“মোর বাহে জাইল্লা আছিলো। জামাই, পোলারা হগলডিই জাইল্লা। কিন্তু এ্যাতো বছরেও এই কাঁড়রা দেহি নাই। কাঁড়রাগুলা দ্যাখতে সুন্দার। মারতে মোন চায় না। কিন্তু এতো কাঁড়রা কি হরবে। হেইয়ার লাইগ্যা বাইচ্ছা হুগাইতাছি”।

জেলে ইব্রাহিম মিয়া বলেন,“আগেও জালে অনেক কাঁড়রা ধরা পড়ছে। কোন কোন সময় চাইর-পাঁচ মনও কাঁড়রা পাইছি। এই এই কাঁড়রা জীবনেও দেহি নাই। এগুলা মনে হয় বিদেশি কাঁকড়া। চিতা বাঘের মতো কাঁড়রাগুলা। তাই এগুলারে টাইগার কাঁড়রা নামে ডাকে।”

কুয়াকাটায় ভ্রমণে আসা পর্যটক সাইদুর রহমান, অঞ্জলি মন্ডল, অরিত্র দেবনাথ জানান, এরকম কাঁকড়া তারা অষ্ট্রেলিয়ার সৈকতে দেখেছেন। এগুলো নিধন বন্ধে এখনই ব্যবস্থা নেয়া উচিত।

কলাপাড়া উপজেলা সিনিয়র মৎস্য কর্মকর্তা মো. কামরুল ইসলাম জানান, কুয়াকাটা সৈকতে ধরা পড়া কাঁকড়া খুবই বিরল ও মূল্যবান প্রজাতির। এ জাতের কাঁকড়া ইন্দো-প্রশান্ত অঞ্চলে খাবার হিসেবে জনপ্রিয়। এশিয়া ও পারস্য অঞ্চলেও এ কাঁকড়ার বেশ খাদ্য চাহিদা আছে। পুরুষ কাঁকড়ার চেয়ে মা কাঁকড়ার মূল্য বেশি। তবে এই কাঁকড়া ধরা বিষয়ে কোনো আইন না থাকায় তারা কিছুই করতে পারছেন না। তবে সুক্ষ্ম ফাঁস কিংবা কারেন্ট জাল দিয়ে যাতে এগুলো শিকার করতে না পারে তার জন্য তাদের অভিযান অব্যাহত রয়েছে।