মিথ্যা ঘোষণায় আসছে ভারতের চাল, পাবনা খাদ্য অফিসের জনস্বার্থবিরোধী উদ্যোগ: ধান-চাল বাণিজ্যে ধস

স্বপন কুমার কুন্ডু, ঈশ্বরদী (পাবনা): পশুখাদ্যের মিথ্যা ঘোষণা দিয়ে ভারত থেকে ব্যাপকহারে চাল আমদানি এবং সরকারি গুদামে চাল সরবরাহের ক্ষেত্রে পাবনা খাদ্য অফিসের পক্ষপাতমূলক নীতির কারণে ঈশ্বরদীর ধান-চাল বাণিজ্যে ধস নেমে এসেছে। এতে ঈশ্বরদীর ছয়শতাধিক চাতাল ও হাস্কিং মিলের প্রায় ৮০ ভাগই বন্ধ হয়ে গেছে। এরকম দ্বৈতনীতি ধান-চাল ব্যবসায়ী আর কৃষকদের বড় ধরনের ক্ষতির মুখে ফেলেছে। কৃষক, শ্রমিক এবং ব্যবসায়ীদের স্বার্থবিরোধী এসব উদ্যোগ বন্ধের দাবি জানিয়েছেন সংশ্লিষ্টরা।

পশুখাদ্যের মিথ্যা ঘোষণার জন্য ভারত থেকে আমদানি করা চালের ক্ষেত্রে কাগজপত্রে কোনো হিসাব দেখানো হয় না। আমদানির পর এসব চাল মনুষ্যখাদ্য হিসেবে স্থানীয়ভাবে বাজারজাত করা হচ্ছে। অন্যদিকে, দীর্ঘদিন ধরে সরকারি গুদামে স্থানীয় চাতাল ও হাস্কিং মিলগুলো চালের অন্যতম যোগানদাতা হলেও পাবনা জেলা খাদ্য অফিস অটো রাইসমিলগুলোকে বিশেষ সুবিধা দিয়ে কম খাদ্যমানসম্পন্ন চাল সংগ্রহের উদ্যোগ নিয়েছে। এতে ব্যবসায়ী ও শ্রমিকসহ স্থানীয় কৃষকরা বড় ধরনের ক্ষতির মুখে পড়েছেন।

ishwardi rice husking
বন্ধ হয়ে যাওয়া একটি চাতাল।

ভারত হতে ঢালাওভাবে চাল আমদানির কারণে উত্তরাঞ্চলের অন্যতম চাল বাণিজ্যকেন্দ্র ঈশ্বরদীর জয়নগর মোকামে চালের বেচাকেনা প্রায় বন্ধ হয়ে গেছে। চাতাল মালিক ও ব্যবসায়ীরা জানান, ধানের বাজার গত দু মাস ধরে পড়তির দিকে থাকায় এক গাড়ি ধান ভাঙ্গিয়ে ব্যবসায়ী বা চাতাল মালিকদের ১০ থেকে ৩০ হাজার টাকা পর্যন্ত লোকসান হচ্ছে। ব্যবসায়ী সাদেক বিশ্বাস জানান, লোকসানের আশংকায় কেউই ঝুঁকি নিয়ে ধান ভাঙ্গাতে সাহস পাচ্ছেন না। ফলে ঈশ্বরদীর মিল মালিক, ধান-চাল ব্যবসায়ীসহ ২০ হাজার চাতাল শ্রমিক বেকার হয়ে পড়েছে। এসব চাতাল শ্রমিকদের প্রায় অর্ধেকই নারী।

জয়নগর এলাকার চাতাল মালিক, ব্যবসায়ী ও শ্রমিকদের সাথে কথা বলে জানা যায়, হরতাল-অবেরোধ ও পরিবহন সমস্যার কারণে দীর্ঘদিন এ মোকামে চাল বিক্রি হয়নি। এরমাঝে ভারত হতে আমদানি করা চালে বাজার সয়লাব করা হয়েছে। আমন মৌসুমের ধান এখনো কৃষক ও চাতাল মালিকদের গুদামে মজুদ রয়েছে। এ অবস্থায় ভারত হতে গোখাদ্যের নামে কম দামে চাল আমদানি করায় দেশি ধান-চালের দাম পড়ে গেছে।

ব্যবসায়ীরা আরো জানান, গুটি স্বর্ণা ধান ৭০০-৭৫০  টাকা থেকে নেমে ৫৯৫-৬০০ টাকা, সুমন স্বর্ণা ৭১৫-৭২০ থেকে নেমে ৬০০-৬২৫ টাকা, ব্রি-৪৯ ধান ৮০০ টাকা থেকে ৬৫০ টাকা, ব্রি-৩৯ ধান ৮০০ টাকা থেকে ৬০০ টাকা, পারিজা ধান ৭০০-৭৫০ টাকা থেকে ৪৫০-৫০০ টাকায় নেমেছে। মিনিকেট ধানের বাজার গত মৌসুমের শুরুতে ৯০০ টাকা মণ থাকলেও এ ধান বর্তমানে ৫৫০ থেকে ৬০০ টাকা দরে বিক্রি হচ্ছে।  এর মধ্যে চলতি বোরো মৌসুমের ধান উঠতে শুরু করেছে।

এরকম অবস্থা বিরাজ করলে ধানের দাম ৩০০ থেকে ৩৫০ টাকায় নেমে আসবে বলে আশংকা করছেন ব্যবসায়ীরা। তারা বলছেন, এতে  কৃষকরা সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হবেন।

চাতাল ও হাস্কিং মিল মালিকরা আরো অভিযোগ করেন যে, গত মৌসুমের লোকসান পুষিয়ে নিতে সারা দেশের মতো ঈশ্বরদীর মিল মালিকরা বোরো মৌসুমে সরকারের খাদ্য গুদামে চাল সরবরাহের জন্য অনেক আশা নিয়ে অপেক্ষা করছেন। এজন্য সরকারিভাবে সংশ্লিষ্ট মিলের সক্ষমতা নির্ধারণ করা হয়েছে। কিন্তু এর মাঝে নতুন করে আবার পাবনা জেলা খাদ্য নিয়ন্ত্রকের কার্যালয় অটো রাইসমিল মালিকদের স্বার্থে একটি সুপারিশ খাদ্য অধিদফতরে পাঠিয়েছেন। এ সক্ষমতা ধান ভেজানোর হাউজ, চাতালে ধান শুকানোর খোলার আকার ও মিলের ধান ভাঙ্গানোর ক্ষমতার ভিত্তিতে নির্ধাারণ করা হয়।

জানা গেছে, অটো রাইসমিলের ক্ষেত্রে প্রতিদিন আট ঘন্টা হিসেবে ১৫ দিনের উৎপাদনের ক্ষমতার ওপর সক্ষমতা নির্ধারণ করা হয়। পাবনা জেলা খাদ্য নিয়ন্ত্রকের কার্যালয় হতে অটো মিল মালিকদের স্বার্থে নতুন করে আট ঘন্টার পরিবর্তে ২৪ ঘন্টার উৎপাদনের ভিত্তিতে সক্ষমতা নির্ধারণের সুপারিশ পাঠানো হয়েছে বলে ঈশ্বরদী মিল মালিক সমিতি সূত্রে জানা গেছে।

সমিতির সভাপতি ফজলুর রহমান জানিয়েছেন, এতে চাতাল ও হাস্কিং মিল মালিকদের গুদামে সরবরাহের জন্য বরাদ্দের পরিমাণ কমে যাবে। গত ২০ এপ্রিল ঈশ্বরদী হাসকিং মিল মালিক সমিতির বার্ষিক সাধারণ সভায় পক্ষপাতমূলক এ সুপারিশের তীব্র প্রতিবাদ জানানো হয়। এ ব্যাপারে জেলা খাদ্য নিয়ন্ত্রকের নিকট মৌখিকভাবে প্রতিবাদও জানানো হয়েছে বলে মিল মালিকরা জানান।

মিল মালিক সমিতির সাবেক সভাপতি আলহাজ্ব শামসুল আলম জানান, পালিশ করার কারণে অটো রাইসমিলে উৎপাদিত চালের কার্বোহাইড্রেট উঠে যায়। ক্যান্সার প্রতিষেধক কার্বোহাইড্রেট না থাকার পাশপাশি এ চালের ভাত স্বাদেও কম এবং অল্প সময়ের মধ্যেই ভাত নষ্ট হয়ে যায়। গত বোরো মৌসুমে অটো রাইসমিলের মালিকরা সরকারি গুদামে চাল সরবরাহ করা থেকে পিছিয়ে গেলে চাতাল ও হাস্কিং মিলাররাই সরকারের সংগ্রহের লক্ষ্যমাত্রা পূরণ করে।

জানা যায়, বর্তমানে দেশে ২৫ হাজার হাস্কিং মিল থাকলেও ১৪ হাজার মিল সরকারের সাথে যুক্ত হয়ে খাদ্য গুদামে চাল সরবরাহ করে। পাশপাশি অটো রাইসমিলের সংখ্যা দেশে পাঁচশতাধিক হলেও ঈশ্বরদীতে রয়েছে পাঁচটি। সমিতি সূত্র জানায়, চলতি মৌসুমে বাজারে ধানের দাম কম থাকায় অটো রাইসমিলের মালিকরা প্রভাব খাটিয়ে তাদের ক্যাপাসিটি বাড়িয়ে বরাদ্দ নেয়ার জন্য চেষ্টা চালাচ্ছে। মিলারদের সাথে খাদ্য বিভাগের কর্মকর্তাদের মতবিনিময় পূর্বক ধান-চাল ক্রয় করার নীতিমালা প্রণয়নের জন্য ঈশ্বরদীর হাস্কিং মিল মালিক সমিতি সরকারের নিকট দাবি জানিয়েছেন।

সমিতির বার্ষিক সাধারণ সভা ও সেমিনারে বক্তারা আরো অভিযোগ করেন, একদিকে চাল আমদানি হচ্ছে, আবার সরকার চাল রফতানিও করছে। এ দ্বৈত নীতির কারণে দেশে আজ কৃষক, চাতাল মালিক, ধান-চাল ব্যবসায়ী ও শ্রমিকরা ক্ষতিগ্রস্ত। চাল আমদানির বিষয়ে সমিতির নেতারা জানান, তাঁরা খোঁজ নিয়ে জেনেছেন, সরকারের খাদ্য ও বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের খাতা-কলমে চাল আমদানির কোনো তথ্য নেই। পশু খাদ্যের নামে ভারত হতে চাল আমদানি করে বাজার সয়লাব করায় এ সংকটের সৃষ্টি হয়েছে। এজন্য সরকারের হস্তক্ষেপ দাবি করেছেন তাঁরা।