রাজশাহী থেকে কাজী শাহেদ: বিডিআর বিদ্রোহের মামলায় যাবজ্জীবন কারাদণ্ড পাওয়া বিএনপি নেতা নাসির উদ্দীন আহম্মেদ পিন্টু মারা গেছেন (ইন্নালিল্লাহি… রাজেউন)। রবিবার দুপুর ১২টা ২০ মিনিটে রাজশাহী কেন্দ্রীয় কারাগার থেকে রাজশাহী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নেওয়ার পথে তার মৃত্যু হয়। তিনি হৃদরোগে আক্রান্ত হয়েছিলেন। রাজশাহী কেন্দ্রীয় কারাগারের ডিআইজি প্রিজন বজলুর রশিদ এ তথ্য নিশ্চিত করেছেন।
ডিআইজি প্রিজন বজলুর রশিদ জানান, বিএনপি নেতা নাসির উদ্দিন পিন্টু সকালে বুকে ব্যথা অনুভব করেন। চিকিৎসকের পরামর্শে তাকে রাজশাহী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নেওয়া হয়। হাসপাতালে নেওয়ার পর ৩২ নম্বর ওয়ার্ডে তার মৃত্যু হয়।
রাজশাহী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের হৃদরোগ বিভাগের প্রধান ডা. রইস উদ্দিন জানান, বিএনপি নেতা পিন্টুকে কারা কর্তৃপক্ষ হাসপাতালে নিয়ে আসার পর তারা পরীক্ষা-নিরীক্ষা শুরু করেন। তবে তাকে মৃত অবস্থায় পেয়েছেন। হাসপাতালে নেওয়ার পথে তার মৃত্যু হয়েছে। তিনি হৃদরোগে আক্রান্ত হয়েছিলেন বলে চিকিৎসক জানান।
নাসির উদ্দীন আহমেদ পিন্টুর ময়নাতদন্ত রবিবার বিকাল ৫টা ৫০ মিনিটে শেষ হয়েছে। রাজশাহী মেডিকেল কলেজের (রামেক) ফরেনসিক বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক কফিল উদ্দিন আকাশ তার ময়নাতদন্ত করেন ।
এর আগে বিকাল সাড়ে ৩টায় নাসির উদ্দিন পিন্টুর লাশের সুরতহাল করা হয়। নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট শিমুল আকতার সুরতহাল করেন। ৬টার দিকে লাশ কারা কর্তৃপক্ষের কাছে বুঝিয়ে দেয় হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ।
ময়নাতদন্ত শেষে লাশ স্বজনদের কাছে হস্তান্তর করা হবে বলে জানিয়েছেন হাসপাতালের পরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল নাছির উদ্দিন আহমদ।
এদিকে নাসির উদ্দিন আহমদ পিন্টুর মৃত্যুতে চিকিৎসায় অবহেলা ছিল বলে অভিযোগ করেছেন তার ভাই নাসিম আহমেদ রিন্টু, বিএনপির যুগ্মমহাসচিব মিজানুর রহমান মিনু ও জেলা ছাত্রদলের সভাপতি শফিকুল আলম সমাপ্ত। নাসিম আহমেদ রিন্টু জানান, তার ভাই অসুস্থ থাকলেও কারা কর্তৃপক্ষ চিকিৎসা করায়নি। শনিবার চিকিৎসক কারাগারে গেলেও তার ভাইয়ের সঙ্গে দেখা করতে দেওয়া হয়নি। রবিবার বুকে ব্যথা অনুভব করলেও তাকে সঠিক সময়ে হাসপাতালে নেওয়া হয়নি। মৃত্যুর পর পিন্টুকে হাসপাতালে নেওয়া হয়।
রাজশাহী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের হৃদরোগ বিভাগের চিকিৎসক ডা. রইস উদ্দিন শনিবার কারাগারে যাওয়ার কথা স্বীকার করে বলেন, ‘কয়েকদিন আগে আমাকে চিঠি দিয়ে কারা কর্তৃপক্ষ ডেকে পাঠায়। শনিবার আমি কারাগারে গেলেও পিন্টুর সঙ্গে দেখা করতে দেওয়া হয়নি।’ পিন্টুর মতো অসুস্থ মানুষের যে ধরনের চিকিৎসা পাওয়ার কথা, তা দেওয়া হয়নি বলে দাবি তার।
এদিকে নাসির উদ্দীন আহমেদ পিন্টুর মৃত্যুর ঘটনায় রাজশাহী মহানগরীর রাজপাড়া থানায় অপমৃত্যু (ইউডি) মামলা হয়েছে। বিকালে হাসপাতালের মৃত্যু সনদের ওপর ভিত্তি করে রাজপাড়া থানা পুলিশ মামলাটি দায়ের করে। হাসপাতালের দেওয়া মৃত্যু সনদে স্বাক্ষর করেছেন ডা. শফিকুল ইসলাম।
থানার অফিসার ইনচার্জ (ওসি) মেহেদি হাসান জানান, বিএনপি নেতা নাসির উদ্দিন আহমেদ পিন্টুর মৃত্যুর ঘটনায় থানায় অপমৃত্যু মামলা হয়েছে। নিয়মানুযায়ী এমন মৃত্যুর ঘটনায় কারাগারের সুপার যথাযথ ব্যবস্থার জন্য থানাকে তাৎক্ষণিকভাবে চিঠি দেন। সেই চিঠি পাওয়ার পর মামলাটি গ্রহণ করা হয়েছে।
২০০৯ সালে আলোচিত পিলখানায় বিডিআর বিদ্রোহের ঘটনায় বিএনপির ঢাকা মহানগর যুগ্মসম্পাদক নাসির উদ্দীন আহম্মেদ পিন্টুর সংশ্লিষ্টতার অভিযোগ ওঠে। এ বিষয়ে সরকারি তদন্ত কমিটির রিপোর্টে পিন্টুর বিরুদ্ধে বিদ্রোহী বিডিআর সদস্যদের পালিয়ে যেতে সহায়তা করার অভিযোগ আনা হয়। সরকারের তদন্ত কমিটির রিপোর্টে বলা হয়, বিএনপির প্রাক্তন ওয়ার্ড কমিশনার সুরাইয়া বেগম, তার দুই ছেলে, স্থানীয় সন্ত্রাসী মাসুদ, লেদার লিটন বিদ্রোহী বিডিআর সদস্যদের কাপড়, পানি ও খাবার সরবরাহ করেছিল। বিদ্রোহ চলাকালে বিডিআরের পক্ষে মিছিল বের করে পিন্টুর সমর্থকরা। বেশকিছু বিদ্রোহী বিডিআর সদস্য বুড়িগঙ্গা নদী ইঞ্জিনচালিত নৌকা দিয়ে পার হয়েছেন। এসব ইঞ্জিনচালিত নৌকার মালিক ছিলেন নাসির উদ্দীন আহম্মেদ পিন্টু। তিনি বিডিআর সদস্যদের নদী পার করে দেওয়ার জন্য তার ইঞ্জিনচালিত নৌকা ব্যবহারের অনুমতি দিয়েছিলেন।
সরকারের এ তদন্ত রিপোর্টে বিদ্র্রোহের সঙ্গে পিন্টুর জড়িত থাকার তথ্য বেরিয়ে আসার পর তিনি কয়েকদিন ধরে হাইকোর্টে যাতায়াত করছিলেন। পিলখানার ঘটনায় যেন তাকে হয়রানি না করা হয়, এ ব্যাপারে আইনি সহায়তার জন্য তিনি তিনদিন ধরে হাইকোর্টে একজন আইনজীবীর সঙ্গে পরামর্শ করেন। সরকারের তদন্ত কমিটির রিপোর্টে বিদ্রোহী বিডিআর সদস্যদের পালিয়ে যেতে সহায়তাকারী হিসেবে পিন্টুর নাম উল্লেখ করায় তিনি এ মামলায় তাকে হয়রানি না করার জন্য হাইকোর্টে একটি রিট আবেদন করেন।
২০০৯ সালের ২ জুন হাইকোর্টের একটি বেঞ্চে রিটটির শুনানি হয়। ওইদিন নাসির উদ্দীন পিন্টু হাইকোর্টে আসেন। পিন্টু হাইকোর্ট চত্বরে অবস্থানকালে তার সহযোগীদের মাধ্যমে জানতে পারেন যে, তাকে গ্রেফতার করতে হাইকোর্ট চত্বরের বাইরে পুলিশ অবস্থান করছে। এ খবর পেয়ে তিনি তার ব্যবহৃত মাইক্রোবাস বাদ দিয়ে একজন সহযোগীর মোটরসাইকেলে চড়েন। মোটরসাইকেলটি হাইকোর্টের মাজার গেট দিয়ে বের হয়ে আসার সঙ্গে সঙ্গে সাদা পোশাকে অবস্থানরত ডিবি পুলিশ পিন্টুকে চিনে ফেলে। পিন্টুকে গ্রেফতার করে ডিবির একটি মাইক্রোবাসে ওঠানো হয়। তাকে নিয়ে যাওয়া হয় মিন্টো রোডে ডিবি কার্যালয়ে। পরে সন্ধ্যায় তাকে সিআইডির কাছে হস্তান্তর করা হয়।
পিলখানায় বিডিআর বিদ্র্রোহের ঘটনায় ১ মার্চ লালবাগ থানায় একটি মামলা হয়। পিলখানার অবস্থান নিউ মার্কেট থানা এলাকায় হওয়ায় এ মামলাটি লালবাগ থানা থেকে স্থানান্তর করা হয়। এই মামলাতেই পিন্টুকে গ্রেফতার দেখানো হয়। ২০১৩ সালের ৫ নভেম্বর পিলখানা হত্যামামলায় নাসির উদ্দীন পিন্টুকে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দেন ঢাকা মহানগর তৃতীয় দায়রা জজ ড. আক্তারুজ্জামানের আদালত।
২০০১ সালে লালবাগ-হাজারীবাগ এলাকা থেকে নাসির উদ্দীন আহম্মেদ পিন্টু সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন। তত্ত্বাবধায়ক সরকার ক্ষমতা গ্রহণের পর ২০০৭ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারি যৌথবাহিনী পিন্টুকে গ্রেফতার করে। তার বিরুদ্ধে হত্যা, ত্রাণের টিন আত্মসাৎ, চাঁদাবাজি, প্রায় ২০ কোটি টাকার অবৈধ সম্পদ অর্জনের অভিযোগসহ ১৫টি মামলা হয়। উচ্চ আদালতের নির্দেশে একটি মামলা স্থগিত থাকলেও বাকিগুলো আদালতে বিচারাধীন আছে।
গত ২০ এপ্রিল তাকে নারায়নগঞ্জ কারাগার থেকে রাজশাহীতে পাঠানো হয়। এরপর থেকে তিনি এখানে ছিলেন।