খুলনা থেকে সোহরাব হোসেন: তেলবাহী ট্যাঙ্কার ‘সাউদার্ন স্টার সেভেন’ ডুবির বিপর্যয় কাটিয়ে উঠতে না উঠতেই সুন্দরবনে এবার ৫০০ মেট্রিকটন এমওপি সার নিয়ে ‘জাবালে নূর’ নামের একটি জাহাজ ডুবে গেছে। ৩ মে (রোববার) বিকেল ৫টার দিকে পূর্ব সুন্দরবনের শরণখোলা রেঞ্জের ভোলা নদের মরাভোলা বিমলের চর এলাকায় জাহাজটি ডুবে যায়। দুর্ঘটনার পর পরই জাহাজের মাস্টার ও নাবিকরা পালিয়ে যায়।
বনবিভাগ ও প্রত্যক্ষদর্শী সূত্রে জানা যায়, মেসার্স আল এহসান শিপিং লাইন্স এর এম-৬৯৪৩ নম্বরের এ জাহাজটি গত ২ মে মংলার হারবাড়িয়া থেকে সার বোঝাই করে সিরাজগঞ্জের বাঘাবাড়ির উদ্দেশ্য রওনা হয়। জাহাজটি ছেড়ে আসার পর ওইদিন পথিমধ্যে শরণখোলা রেঞ্জের ভোলা নদের বিমলের চর এলাকায় এলে বিপরীত দিক থেকে আসা একটি জাহাজকে সাইড দিতে গিয়ে ওই জাহাজটি প্রথমে ডুবো চরে আটকে পড়ে। পরে ঢেউয়ের আঘাতে সেটি ফেটে ডুবে যায়।
ইতিমধ্যে জাহাজটি উদ্ধারে মংলা থেকে এমবি নূসরাত-ই-হক ও এমভি তছির উদ্দিন নামের দুটি জাহাজ ঘটনাস্থলে পৌঁছেছে এবং অতিগোপনে মালিক পক্ষ গলিত সার পানিতে ফেলে জাহাজটি উদ্ধারের চেষ্টা চালায়। সার বোঝাই জাহাজডুবির এলাকা ডলফিন ও শুশুকের বিচরণ ক্ষেত্র হওয়ায় সুন্দরবন আবারও বির্যয়ের মুখে পড়তে পারে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে।
মঙ্গলবার দুপুরে ঘটনাস্থল ঘুরে আসা ব্যক্তিরা জানান, জাবালে নূর জাহাজটি পানিতে নিমজ্জিত রয়েছে। সার গলে সুন্দরবনের নদী ও খালের পানিতে ছড়িয়ে পড়ছে। সার পানিতে মিশে লাল রঙে পানি বিবর্ণ হতে শুরু করেছে। জোয়ারের পানির চাপ ও স্রোত বেশি থাকায় উদ্ধারকারী জাহাজ দুটি ডুবো জাহাজের কিছু দূরে নোঙর করে আছে। স্রোত কমলে তাদের উদ্ধার তৎপরতা শুরু করা হবে বলে নুসরাত-ই-হক জাহাজের মাস্টারা আব্দুল মালেক জানান।
তিনি জানান, ডুবে যাওয়া জাহাজটি প্রথমে চরে আটকে যাওয়ার খবর শুনে তার মালিক মো. নূরুল হক সেটি উদ্ধারের জন্য সোমবার সকালে তাকে ঘটনাস্থলে পাঠান। কিন্তু উদ্ধার কাজ শুরু করার আগেই ঢেউয়ের আঘাতে জাহাজটি মাঝখান থেকে ফেটে পানিতে ডুবে যায়।
এ সময় ঘটনাস্থল পরিদর্শনে আসা শরণখোলা স্টেশনের সহকারী স্টেশন কর্মকর্তা মো. মাসুদুর রহমান বলেন, ডুবে যাওয়া জাহাজটিতে ৫০০ মেট্রিকটনের মতো লাল রঙের এমওপি সার রয়েছে। জাহাজটির কিছু পিছনের অংশ ছাড়া সম্পূর্ণটাই পানিতে নিমজ্জিত রয়েছে। সারের লাল রং পানিতে ছড়িয়ে পড়তে শুরু করেছে। ওই জাহাজের সংরক্ষিত তেলও পানিতে ছড়িয়ে পড়তে পারে। তবে, ডুবো জাহাজের মাস্টার ও নাবিক কাউকেই এ সময় ঘটনাস্থলে পাওয়া যায়নি।
বেসরকারি গবেষণা সংস্থা সেভ দ্য সুন্দরবন ফাউন্ডেশনের চেয়ারম্যান ড. ফরিদুল ইসলাম বলেন, সারের রাসায়নিক বিষক্রিয়ায় বিরল প্রজাতির ডলফিন, শুশুক, বিভিন্ন প্রজাতির মাছসহ অন্যান্য জলজ প্রাণির মারাত্মক ক্ষতির আশঙ্কা রয়েছে।
খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ের এ্যাগ্রো টেকনোলজি বিভাগের প্রফেসর সরদার সরিফুল ইসলাম জানান, সার গলে পানির গুণগত মান ও জলজ প্রাণির ক্ষতির আশঙ্কা রয়েছে। সারবাহী জাহাজ ডুবির ঘটনাটি সুন্দরবন বিপর্যয়ের আরেকটি প্রধান কারণ বলে তিনি মন্তব্য করেন।
সুন্দরবন পূর্ব বিভাগের বিভাগীয় বন কর্মকর্তা (ডিএফও) মো. আমীর হোসাইন চৌধুরী বলেন, ডুবে যাওয়া পটাশ (এমওপি) জাতীয় এ সারের বিষক্রিয়ায় গাছপালার চেয়ে জলজ প্রাণির ক্ষতির আশঙ্কা বেশি। জাহাজটি উদ্ধারের জন্য চেষ্টা চলছে বলে তাকে মালিক পক্ষ জানিয়েছে। তবে, গলিত সার পানিতে ফেলা হলে জাহাজটির বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
এর আগে ২০১৪ সালের ৯ ডিসেম্বর চাঁদদপাই রেঞ্জের শ্যালা নদীতে ফার্নেস তেলবাহী ‘সাউদার্ণ স্টার সেভেন’ নামের একটি জাহাজ ডুবে ছিল। সেই জাহাজের ক্ষতিকর তেল সুন্দরবনের সমস্ত নদনদীতে মিশে বনে মারাত্মক বিপর্যয় ঘটে। সেই থেকে এক মাস সুন্দরবনের অভ্যন্তর থেকে সব ধরণের জাহাজ চলাচল বন্ধ থাকে। বিকল্প পথ না থাকায় পুনরায় জাহাজ চলাচল শুরু হয়। ওই ঘটনার ৫ মাসের মাথায় সারবাহী জাহাজ ডুবির ঘটনা ঘটল।