ময়মনসিংহ অঞ্চলের কৃষক ২ হাজার কোটি টাকা লোকসানের মুখে

গফরগাঁও (ময়মনসিংহ) থেকে আতাউর রহমান মিন্টু: বৃহত্তর ময়মনসিংহ অঞ্চলের হাওড়, বাওড়, গারো পাহাড় আর বিশাল সমতল ভূমির দিগন্ত বিস্তৃত মাঠের বুক জুড়ে থাকা সোনারাঙা পাকা বোরো ধান কাটা শেষ পর্যায়ে। ব্যাপক ফলন হলেও খুশি হওয়ার পরিবর্তে কৃষক হতাশ।

gafargaon pic.3.13.05.2015
কারণ ধান উৎপাদন করে কৃষক কমপক্ষে মনপ্রতি ১৫০ টাকা করে লোকসান গুনছেন। এতে এ অঞ্চলের প্রায ২০ লাক কৃষক পরিবারের দুই হাজার কোটি টাকা লোকসান গুনতে হবে। সিন্ডিকেট ব্যবসায়ীদের বাজার নিয়ন্ত্রণ, সরকারি গুদামে কৃষকদের ধান-চাল বিক্রি করতে না পারা, শ্রমিক মুজুরিসহ  অন্যান্য কারণে উৎপাদন খরচ বেড়ে যাওয়া, আমদানি করা চালে বাজার সয়লাব হওয়ায় ধানের দাম কমে যাওয়ার কারণে এ অঞ্চলের কৃষকদের এ লোকসান গুনতে হচ্ছে।

কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর (ডিএই) ময়মনসিংহ অঞ্চলের অতিরিক্ত পরিচালকের কার্যালয় সূত্রে জানা গেছে, অনুকূল আবহাওয়া, আগাম বন্যা না আসায়, সেচ ও সারের সংকট এবং রোগবালাই না থাকায় ময়মনসিংহ অঞ্চলে বোরো ধানের প্রচুর ফলন হয়েছে। ডিএই আশা করছে, শুধু ময়মনসিংহ অঞ্চলে প্রায় ৫০ লাখ মেট্রিক টন বোরো ধান উৎপাদন হবে। ময়মনসিংহ অঞ্চলের ৫ জেলার এ উৎপাদন চলতি মৌসুমে দেশের মোট বোরো উৎপাদনের ১৬.১৫ শতাংশ।

ডিএই সূত্রে জানা গেছে, ময়মনসিংহ, নেত্রকোনা, জামালপুর, কিশোরগঞ্জ, শেরপুর-ময়মনসিংহ অঞ্চলের এ ৫ জেলায় চলতি মৌসুমে ৮ লাখ ৩১ হাজার ১শ ২৫ হেক্টর জমি বোরো আবাদের আওতায় এসেছে। যা লক্ষমাত্রার চেয়ে ১০ হাজার ৪শ ৯০ হেক্টর বেশি। গত মৌসুমে আবাদ হয়েছিল ৮ লাখ ২৬ হাজার ৬শ ১১ হেক্টর জমিতে। কৃষি সম্প্রসারণ বিভাগ জানিয়েছে, বুধবার পর্যন্ত ময়মনসিংহ অঞ্চলে ৮৫ ভাগ বোরো ধান কাটা হয়েছে।

কৃষি বিভাগের তথ্য অনুযায়ী জানা গেছে, আগামী ১ সপ্তাহের মধ্যে বোরো ধান কাটা প্রায় শেষ হবে। এ সময়ের মধ্যে বড় ধরনের আর কোনও বিপর্যয় না ঘটলে এ অঞ্চলে উফশী, হাইব্রীড এবং স্থানীয় জাতের বোরো ধানের হেক্টর প্রতি গড়ে ৬ মেট্রিক টন হারে উৎপাদন হবে। এ হিসাব অনুযায়ী চলতি মৌসুমে ময়মনসিংহ অঞ্চলে ৫০ লাখ মেট্রিক টন ধান উৎপাদনের সম্ভবনা রয়েছে। ৫০০ টাকা মন গড় মূল্যে উৎপাদিত এ ধানের বাজার মূল্য প্রায় ৬ হাজার ৭’শ কোটি টাকা।

গত ৩ সপ্তাহ যাবৎ এ অঞ্চলের হাট বাজারে নতুন ধান উঠতে শুরু করেছে। মঙ্গলবার ত্রিশাল উপজেলার ধলা বাজারে উফশী জাতের ব্রীআর-২৯ ধান ৫৪০ টাকা থেকে ৫৬০টাকা মন ধরে বিক্রি হতে দেখা গেছে। কিশোরগঞ্জের তারাইল উপজেলার কলমা গ্রামের কৃষক রফিক উদ্দিন খান টিপু (৪২) জানায়, গত রবিবার তারাইল বাজারে হাইব্রীড জাতের নতুন মোটা বোরো ধান ৪৫০ টাকা থেকে ৪৬০ টাকা ধরে বিক্রি হয়েছে। কৃষকদের সাথে কথা বলে জানা গেছে, চলতি মৌসুমের শুরুতে হাইব্রীডের মোটা বোরো ধান ৪০০টাকা থেকে ৪৩০ টাকা এবং ব্রীআর-২৯ ধান ৪৮০ টাকা থেকে ৫১০ টাকা মন দরে বিক্রি হয়েছে।

জানা গেছে, জমির ভাড়া, সেচ, হাল চাষ-রোপনের খরচ, সার-বীজ-নিড়ানি-কীটনাশক, কাটা-মাড়াইসহ  সরকারি হিসেবে এবারের বোরো মৌসুমে প্রতি কেজি বোরো ধান উৎপাদন ব্যয় ২০ টাকা এবং প্রতি কেজি চাল উৎপাদন খরচ হবে ২৭ টাকা। সে হিসেবে এক মন ধানের উৎপাদন খরচ  হয়েছে ৭৪৬.৪০ টাকা। যদিও কৃষকরা বলেছেন এলাকাভেদে এ ব্যয় ৩০-৪০টাকা কম বেশি হতে পারে। এক মন ধানের খড়ের বিক্রিমূল্য গড়ে ১০০ টাকা । তারপরও কৃষকরা ধান বিক্রিতে বাধ্য হচ্ছেন উৎপাদন খরচ থেকে গড়ে কমপক্ষে ১৫০ টাকা মন কমদরে। সে হিসেবে এ অঞ্চলে ২০ লাখ কৃষক পরিবার প্রায় ৫০ লাখ মেট্রিক ধান উৎপাদন করে প্রায় ২ হাজার কোটি টাকার ক্ষতির মুখোমুখি হবে। সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হবে এ অঞ্চলের ৭ লাখ ৬০ হাজার ভূমিহীন কৃষক, ৭ লাখ ৫০ হাজার প্রান্তিক আর ৪ লাখ ক্ষুদ্র কৃষক।

সম্প্রতি এ অঞ্চলের হাটবাজারে প্রচুর বোরো ধান আমদানি হয়েছে। কিন্ত চালকল মালিক ও সিন্ডিকেট ব্যবসায়ীদের দখলে বাজারদর। গফরগাঁও উপজেলার বাঘেরগাঁও গ্রামের কৃষক ফালুমিয়া(৪৮), চরআলগী গ্রামের কৃষক সুরুজ মিয়া(৫২) জানান, চালকল মালিক ও মৌসুমি ব্যবসায়ীরা সিন্ডিকেট করে কমদরে ধান কিনছে। সরকারি গুদামে ধান-চাল সংগ্রহ শুরু না হওয়ায়, বাজারে আমদানি করা চালে সয়লাব থাকার অজুহাত আর নজরদারীর অভাবকে পুঁিজ করে এসব ব্যবসায়ীরা ধানের বাজার নি¤œমূখী করে মুনাফা লুটছে। আর কৃষকরা ধান উৎপাদনে নেওয়া দেনার টাকা, ধান কাটা ও মাড়াই এর মজুরি খরচ পরিশোধের তাগিদে কমদামে ধান বিক্রি করতে বাধ্য হচ্ছে। ধলা বাজারে ধান বিক্রি করতে আসা ত্রিশাল উপজেলা নামাপাড়া গ্রামের তোফাজ্জল হোসেন (৬০), গফরগাঁও উপজেলার লক্ষনপুর গ্রামের উজ্জল মিয়া (৪১)জানান, খরচ করে ধান করে ন্যয্যমূল্যের জন্য মানুষের হাতে পায়ে ধরতে হয়। নান্দাইল উপজেলার চরপাড়া গ্রামের কৃষক খালেক (৫৫) জানায়, চলতি বোরো আবাদে সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত আমাদের মত ভূমিহীন বর্গাচাষীরা। আমরা ধারদেনা করে ধান আবাদ করে লোকসানে পড়ে ধারদেনাও শোধ করতে পারবো না। আমাদের শূণ্য গোলা শূণ্যই পড়ে থাকবে।

সূত্রমতে ধানের ন্যায্যমূল্য নিশ্চিত করতে গত ৩ এপ্রিল সরকার ধান-চালের দাম নির্ধারণ করেছে। সেই অনুযায়ী গত ১ মে থেকে ২২টাকা কেজি ধরে ধান ও ৩২ টাকা কেজি ধরে চাল সংগ্রহ করার কথা। কিন্ত ময়মনসিংহ অঞ্চলের কোথাও ধান-চাল সংগ্রহ অভিযান শুরু হয়নি।

গফরগাঁও উপজেলার কৃষক আবুল বাশার (৪৬) অভিযোগ করে বলেন, সরকারি মূল্য নির্ধারণে আমাদের লাভ কি? কৃষকতো সরকারি গুদামে ধান বিক্রি করতে পারেনা। নানা অজুহাতে কৃষকের ধান কেনা হয়না। আর যখন কৃষকের ঘরে ধান থাকে তখন সরকার ধান কিনে না। তাই বাজারে ধানের দাম থাকে না। কৃষকের গোলার ধান ফুরিয়ে গেলে সরকার ধান কিনতে শুরু করে। বাজারেও দাম বাড়ে।

এ ব্যাপারে ময়মনসিংহ জেলা খাদ্য নিয়ন্ত্রক মাহবুবুর রহমান বলেন, নির্ধারিত মূল্যে ধান-চাউল সংগ্রহের জন্য সরকারের পক্ষ এ জেলায় ৫হাজার ৩’শ মেট্রিক টন ধান এবং ৪৮ হাজার ৫’শ মেট্রিক টন চাল ক্রয়ের বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে। আশা করা যাচ্ছে, আগামী ১০/১৫ দিনের মধ্যে ২২টাকা কেজি দরে ধান এবং ৩২ টাকা কেজি ধরে চাল সংগ্রহ করা যাবে।