রেজাউল করিম বকুল, শেরপুর: ভারতের মেঘালয়ের পাদদেশে সবুজ গারো পাহাড়। সীমান্তের পাহাড়-নদী ঘেরা শ্রীবরদী উপজেলার একটা বড় অংশের অবস্থান এ পাহাড়ি এলাকায়। কর্ণঝোরা, মেঘাদল, বাবেলাকোনা, চান্দাপাড়া, হারিয়াকোনা, দিঘলাকোনা, মালাকোচাসহ ২০টির বেশি পাহাড়ি জনপদ রয়েছে এখানে। পাহাড়গুলো সব মনোমুগ্ধকর। প্রায় ৩০০ ফুট উচুঁ ও বিশাল সমতল ভূমি নিয়ে রাজার পাহাড়, এখানকার পাহাড়গুলোর রাজা। একবার দেখলেই সৌন্দর্যের সেই পরশ অনুভূত হতে থাকে বহুদিন ধরে।
প্রাচীনকালে এখানে এক রাজার বাড়ি ছিল বলে এর নাম হয়েছে রাজার পাহাড়। আবার পাহাড়টির আয়তন ও উচ্চতা বেশি বলে একে রাজার পাহাড় বলেন অনেকে। পাহাড়ি পথ বেয়ে উঠতে হয় এর চূড়ায়। পাহাড়ের চূড়ায় রয়েছে সেই রাজার সমাধি ও স্মৃতিস্তম্ভ। আড়াইশ একরের বেশি চওড়া পাহাড়ের চূড়ার সবটাই সমতল। পাগলা দারোগা নামে এক ব্যক্তির বাড়ি ছিল রাজার পাহাড়ের চূড়ায়। ১৯৮০ সালে তিনি মারা যান। তার ছেলেমেয়েরা এখানেই থাকে। টিলার এক কোনায় এ পরিবার গড়ে তোলে কাঁঠাল লিচু ও কলার বাগান। বন আর বাগানের সবুজ যেন ধরতে চাইছে বহুদূরের বিশাল আকাশটাকে
আশপাশের পাহাড়গুলোর চেয়ে আলাদা এটি। চূড়ার অর্ধেকটাই তৃণভূমি, যেন নরম ঘাসের গালিচা। বাকি অংশে বন বিভাগের আকাশমণি ও মেহগনি গাছের বাগান। নানা প্রজাতির পাখির আবাস এখানে। কাঠবিড়ালীদের অবাধ ছুটোছুটি। কথা হয় বেড়াতে আসা কয়েকজনের সাথে। পাহাড়ের মনোরম পরিবেশ ও কাঠবিড়ালীর ছুটোাছুটি আর চেঁচামেচি অভিভূত করেছে তাদের।
পাহাড়ের শিখরে দাঁড়িয়ে আশেপাশে তাকালে দেখা যায় ছোট ছোট অসংখ্য টিলা। পাহাড়ের পাশ ঘেঁসে বয়ে গেছে পাগলা বা ঢেউফা নদী। সারা বছর এ নদীতে হাঁটুপানি থাকে। সেই শীতল পানিতে শরীর ভেজাতে নেমে পড়েন অনেকেই। নিচের দিকে রয়েছে অসংখ্য ঝর্না। বহু মানুষ এসব দেখতে বেড়াতে আসেন এখানে। যাতায়াতের সুযোগ-সুবিধা বাড়িয়ে প্রচার চালালে অনেক সম্ভাবনার পর্যটন কেন্দ্র হিসেবে গড়ে উঠতে পারে রাজার পাহাড়।
শেরপুর জেলা সদর হতে ৩৪ কিলোমিটার দূরে কর্ণঝোরা বাজারের খুব কাছেই রাজার পাহাড় ও বাবেলাকোনা গ্রাম। জেলা সদর হতে বাস, টেম্পো, মাইক্রোসহ যে কোনো যানবাহনে আসা যায় রাজার পাহাড়ে। সরকারি-বেসরকারি বা ব্যক্তি-উদ্যোগে এ পাহাড়কে পর্যটন বা ইকো পার্ক হিসেবে গড়ে তোলার যথেষ্ট সম্ভাবনা রয়েছে। এতে স্থানীয় মানুষদের যেমন কর্মসংস্থান হবে, তেমনি সরকারও রাজস্ব আয় করতে পারবে।
রাজার পাহাড় উত্তর পাশে বাবেলাকোনা গ্রাম। বহু টিলা আর সমতল ভূমির মধ্যে গড়ে ওঠেছে এ প্রাচীন বসতি। আদিবাসীদের এ গাঁ যেন প্রকৃতি আর মানুষের মেলবন্ধন। গারো, কোচ, হাজং ও মান্দি সম্প্রদায়ের প্রায় ৫০০ পরিবার জীবনের রকমারি আয়োজনে ব্যস্ত। এ গ্রামে রয়েছে আদিবাীদের কালচারাল একাডেমি, সংস্কৃতিবিষয়ক জাদুঘর, আদিবাসীসহ বিভিন্ন বিষয়ের বইপত্র নিয়ে লাইব্রেরি, আদিবাসীদের শিক্ষা, সংস্কৃতি ও উন্নয়নের জন্যে গবেষণাগার ইত্যাদি। আদিবাসীদের বিচিত্র জীবনের পরিচয় দেয় সেগুলো। একটি মিশনারি, একটি প্রাইমারি স্কুল ও একটি আদিবাসী হাইস্কুল রয়েছে বাবেলাকোনায়। এছাড়াও আদিবাসীদের কারুকার্যমণ্ডিত গির্জা, মন্দিরসহ অনেক নিদর্শন রয়েছে এখানে। আরো রয়েছে ওয়ার্ল্ড ভিশনের অফিস, বন বিভাগের বিট অফিস, বিডিআর ক্যাম্প ও রাবার বাগান।
আদিবাসীদের জীবনধারা পর্যটকদের আকৃষ্ট করে। বাবেলাকোনায় ঢেউফা নদীর একটি শাখার প্রায় ৪০০ একর জলাভূমি যেন একটি প্রাকৃতিক লেক। কেউ এখানে এলে লেকে নামার লোভ সামলাতে পারে না।
বর্ষার জোয়ারে ঢেউফা নদী কানায় কানায় ভরে ওঠে। তিন-চার ঘন্টা পর লাগে ভাটার টান। নদীর সিংহভাগ শুকিয়ে বালু চিকচিক করে। নদীর বুক জুড়ে যেন বিস্তীর্ণ বালুচর। ইমারত গড়ার জন্যে এখান থেকে সংগ্রহ করা হয় বালু। ঢেউফা নদীতে সারাবছরই হাঁটুপানি থাকে। নদী এখানে নিরন্তর খরস্রোতা।
সব মৌসুমেই বেড়াতে আসা যায় রাজার পাহাড়ে। সৌন্দর্যপিপাসী বহু মানুষ আসে এখানে। দেশের বিভিন্ন এলাকার মানুষসহ বিদেশিরাও আসেন। একজন পর্যটক জানালেন, এখানে সারা বছরই আসার মতো পরিবেশ রয়েছে। একবার কেউ এলে বার বার তার মন ছুটে আসতে চাইবে এ পাহাড়ে।
শীত এলে প্রতিদিন কয়েক শ’ মানুষ আসে এখানে। পর্যটকদের নিরাপত্তার জন্যে স্থানীয় বিডিআর ক্যাম্প সহায়তা দেয়। বর্তমানে পাহাড়ে থাকার কোনো ব্যবস্থা নেই। এর তিন কিলোমিটার পশ্চিমে জামালপুর জেলার বকশীগঞ্জ উপজেলার ডুমুরতলা অবকাশ সেন্টার ও সাত কিলোমিটার পূর্বে ঝিনাইগাতী উপজেলার গজনী ও নালিতাবাড়ী উপজেলার সন্ধকুড়া ইকোপার্ক থাকলেও এর চাহিদা হবে বেশি। কারণ এখানকার প্রাকৃতিক দৃশ্য অনেকটাই ব্যতিক্রম।
অমিত সম্ভাবনা থাকলেও রাজার পাহাড় ঘিরে এখনো পর্যটন কেন্দ্র গড়ে ওঠেনি। তারপর বহু মানুষের আগ্রহের কেন্দ্রবিন্দু ব্যতিক্রমী প্রাকৃতিক পরিবেশের এই পাহাড় আর আশপাশের এলাকা। বহু মানুষ আসেন এখানে। ঘুরে দেখেন রাজার পাহাড়। মানুষের এই আগ্রহকে ঘিরে এলাকাবাসী বহুদিন ধরে স্বপ্ন দেখেন- রাজার পাহাড়কে ঘিরে করে এখানে পর্যটন কেন্দ্র গড়ে উঠবে ।