আতাউর রহমান মিন্টু, গফরগাঁও (ময়মনসিংহ): মশাখালী ইউনিয়নের বলদী গ্রাম। খাল-বিল-নদী-নালা বেষ্টিত এ গ্রামের বেশির ভাগ জমিই বছরের অধিকাংশ সময় পানিতে তলিয়ে অনাবাদি পড়ে থাকে। স্বল্প ফসলি এ গ্রামের অধিকাংশ লোকই ছিল একসময় হতদরিদ্র। তবে গ্রামের নারীদের অক্লান্ত হাত বদলে দিয়েছে বলদী গ্রামের এ দীনহীন চিত্র।
গ্রামের বেশিরভাগ পুরুষই ছিল দিনমজুর। নারী আর শিশুরাও তাই। সম্পন্ন গৃহস্থের বাড়িতে তাদের খাটা-খাটনি টিকিয়ে রাখত সংসার। বলদী গ্রামের নারী-শিশুদের এখন ব্যস্ততা হাতপাখা তৈরিতে। শিশুরা এখন লেখাপড়া শিখছে, স্বপ্ন দেখছে আরও অনেক দূর যাবার।
উপজেলার সদর থেকে ছয় কিলোমিটার দূরের বলদী গ্রাম এখন ‘হাতপাখার গ্রাম’ হিসেবে ব্যাপক পরিচিতি পেয়েছে । গ্রামের দু শতাধিক পরিবারের পেশা এখন হাতপাখা তৈরি এবং বিক্রি করা। হাতপাখাকে ঘিরেই আবর্তিত হচ্ছে তাদের জীবন-জীবিকা। এ কাজের মাধ্যমে তাদের আর্থিক অবস্থার পরিবর্তন ঘটেছে।
গ্রামের হাফিজা খাতুন (৭০) প্রায় ২৫ বছর আগে বিধবা হয়েছেন। ছয় ছেলেমেয়ের সংসারে ছিল চরম অভাব। খেয়ে না-খেয়ে দিন কাটত । হাতপাখা তার সংসারে সুদিন এনে দিয়েছে। হাফিজা বললেন, হাতপাখাই তার সংসার টিকিয়ে রেখেছে। গ্রামের অন্যদের মতো হাতপাখা তৈরির কাজ শুরু করেন। তার মেয়েরাও এ কাজ শিখে নেয়। ছেলেরা হাতপাখা বিক্রি করে। সুখে আছেন তিনি।
পঞ্চম শ্রেণির ছাত্রী লায়লা আক্তার, ১২ বছরের সাহিদা, নিলুফা, শিশু শ্রেণির ছাত্রী শারীন, সিয়া থেকে শুরু করে ৭০ বছরের বৃদ্ধ হেলাল উদ্দিন, দিলারা বেগম সবারই ব্যস্ততা হাতপাখা বানানোয়।
হাতপাখা তৈরির প্রধান উপকরণ গার্মেন্টেসের টুকরো কাগজ, বাঁশের চাকা ও শলাকা, সুঁই, রঙিন সুতা। প্রথম বাঁশের চাকার উপর কাপড় বসিয়ে কাচি দিয়ে কাপড় গোল করে কেটে নির্দিষ্ট জায়গায় পেন্সিল দিয়ে নকশা এঁকে সুঁই-সুতা দিয়ে এর উপর সূচিকর্ম করা হয়। তার আগে থেকেই তৈরি বাঁশের রঙিন শলাকার মধ্যে কাপড় রঙিন সুঁই-সুতা দিয়ে বাঁধা হয়। এভাবেই তৈরি করা হয় হাতপাখা।
পুরানো ঐতিহ্য ও নকশা অনুসরণ করে বলদী গ্রামের মেয়েরা নিজেরাই বিচিত্র নকশার কাজ করে থাকে। হাতপাখায় পশুপাখি, মাছ, ধানের শীষ, নৌকা, কুলা, পালকিসহ নানা ছবি ফুটিয়ে তোলেন নিপুণ হাতে।
রহিমা খাতুন জানান, তিনি একদিনে ৪০-৫০টি পাখা তৈরি করতে পারেন। বাঁশের বেতি তোলা, শলা তৈরি, কাপড়সহ অন্যান্য উপকরণ সংগ্রহ করা পুরুষের কাজ। পাখা বাঁধাইয়ের কাজ করে মেয়েরা। সপ্তম শ্রেণির ছাত্রী লায়লা আক্তার জানায়, পড়াশোনার ফাঁকে ফাঁকে অবসর সময়ে কাজ করে সে দিনে ১৫-২০টির মতো হাতপাখা তৈরি করতে পারে।
বলদী গ্রামে এখন হাতপাখার পাইকারদের ভিড়। হাতপাখার শিল্পীরা এখন সব চেয়ে ব্যস্ত সময় কাটাচ্ছেন। চাহিদা অনুযায়ী পাখা সরবরাহ করতে বাড়তি পরিশ্রম করছেন।একটি হাতপাখা বানাতে খরচ হয় চার থেকে পাঁচ টাকা। ছয় থেকে সাত টাকায় পাইকারদের কাছে তা বিক্রি করা যায়। আগে হাটবাজারে ঘুরে ঘুরে পাখা বিক্রি করতে হতো। এখন আর বাজারে ঘুরতে হয় না। ঢাকা, ময়মনসিংহ, পাবনা, নরসিংদী, যশোরসহ বিভিন্ন জেলার পাইকাররা বাড়িতে এসে পাখা নিয়ে যায়। বলদী গ্রামের বাড়িতে বাড়িতে সবসময় পাঁচ-ছয় শ’ পাখা মজুদ থাকে। একেকটি পরিবার বছর শেষে পাখা বিক্রি আয় করে ৪০ হাজার থেকে ৭০ হাজার টাকা।
হাতপাখার বদৌলতে পাল্টে গেছে বলদী গ্রামের আর্থ-সামাজিক অবস্থা। জীর্ণশীর্ণ কুঁড়েঘর, মাটির দেয়ালের বদলে উঠছে দালান। কয়েকশ’ হতদরিদ্র নারী স্বাবলম্বী হয়ে উঠেছেন। গ্রামের স্বচ্ছল পরিবারের গৃহিনীরাও যুক্ত হচ্ছেন হাতপাখা তৈরির কাজে।