‘হালিমা না থাকলে আমার বাইচ্চা থাকা কঠিন অইতো’

এম. সুরুজ্জামান, শেরপুর: প্রতিদিন ভোরে ঘুম থেকে উঠে স্বামীকে নামাজ পড়ার জন্য অজু করানো, সকালের নাশতা খাওয়ানো, দুপুরে গোসল করানো, কাপড় পরানো আর রাতে তাকে পিঠে নিয়ে ঘুরে বেড়ানোসহ হাসিমুখে সবই করেন তিনি। নয় বছর ধরে ভালবাসার মানুষটির জন্য এভাবেই নিরবে নিজের কাজ করে চলেছেন হালিমা বেগম (৫১)। তাইতো স্ত্রীর ভালবাসায় স্বামী আমজাদ আলী দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলে উঠেন, “হালিমা না থাকলে আমার বাইচ্চা থাকা কঠিন অইতো”। এই দম্পতির বাড়ি শেরপুরের নালিতাবাড়ী উপজেলার দক্ষিণ রানীগাঁও গ্রামে।

Valobasha
স্বামীকে কাধে নিয়ে ঘুড়ে বেড়ায় হালিমা

৩৬ বছর আগে আমজাদ আলীর (৫৯) সঙ্গে বিয়ে হয় হালিমা বেগমের। হালিমা ও তার স্বামী অন্যের বাড়িতে দিনমজুরি করতেন। জমানো টাকায় তারা ৩০ শতক আবাদি জমি কিনেন। পাঁচ বছরের মধ্যে তাদের ঘর আলো করে আসে দুটি সন্তান। ২০০৫ সালে আমজাদের ডান পায়ের আঙ্গুলে ছোট্ট একটি ফোঁড়া উঠে। চিকিৎসকের পরামর্শে কেটে ফেলতে হয় আঙ্গুলটি। চিকিৎসকরা বলেন, এটি বারজার রোগ। এ রোগে এক বছরের মধ্যে পা থেকে কোমর পর্যন্ত কেটে ফেলতে হয়। পা কেটে ফেলার পর আমজাদ আলী প্রথম দিকে এক পায়ের উপর ভর করে কিছুটা চলতে-ফিরতে পারতেন। তবে চার বছরের ব্যবধানে একই রোগে বাম পা-ও কেটে ফেলতে হয়।

এই দম্পতি ৬ শতক জমির উপর ছোট্ট টিনের ঘরে বাস করেন। হালিমা বেগম জানান, তার স্বামীর পায়ে চার বার অস্ত্রোপচার করতে ৮০ হাজার টাকার মতো খরচ হয়েছে। শেষ সম্বল জমিটুকু বন্ধক দিয়ে স্বামীর চিকিৎসা করেছেন। দুটি পা কেটে ফেলায় সারাক্ষণ ঘরেই থাকতে হয়। তাই স্বামীকে একা রেখে অন্যের বাড়িতে কাজ করা সম্ভব হয় না হালিমার। তবে জীবন বাঁচানোর তাগিদে ২০০৯ সালে কাজের সন্ধানে তারা ঢাকায় চলে যান। আমজাদ আলী ভিক্ষাবৃত্তি আর হালিমা একটি গার্মেন্টসে ঝাড়ুদারের কাজ শুরু করেন। ২০১২ সালের জানুয়ারিতে হালিমার অসুখ হলে তারা দু’জনই গ্রামের বাড়িতে ফিরে আসেন। ঢাকা থেকে ফিরেই বন্ধক দেওয়া জমিটুকু ছাড়িয়ে নেন। বর্তমানে ছেলে হাফিজুর রহমান ঢাকায় রিকশা চালান। আর মেয়ে আঞ্জুয়ারা বেগমের বিয়ে হয়েছে পাশের গ্রামে।

সন্তানেরা সহযোগিতা করেন কি না? জানতে চাইলে আমজাদ আলী বলেন, ‘তাদেরই ঠিকমতো সংসার চলে না, আমগরে সাহায্য করব কীভাবে? তবে অসুখ-বিসুখের কথা হুনলে মেয়েডা ছুইটা আহে।’ এই অসহায় জীবনে স্ত্রী কখনো অবহেলা বা বিরক্তবোধ করেছেন কিনা? জানতে চাইলে ছলছল নয়নে আমজাদ আলী বলেন, ‘ইচ্ছা করলে হালিমা আমারে ফালাইয়া চইলা যাইতে পারত। অসুস্থ অবস্থায় বিছানায় যখন পইড়া থাকতাম, তখন প্রচণ্ড অস্থির লাগত। ঘুম আইত না। লোকজনের আড়ালে রাতে হালিমা আমারে পিঠে নিয়া গ্রামের সড়কে সড়কে ঘুইরা রেড়াইত। স্ত্রীর জন্য কিছু করার সুযোগ পেয়েছিলেন কি না? জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘আবাদি জমিটুকু হালিমার নামে কিনছিলাম। আর বাকি যা দেওয়ার সবকিছু হালিমাই আমারে দিছে।’

হালিমার বলেন, ‘কষ্টকে এখন আর কষ্ট মনে হয় না। বাকি জীবনটা এই পঙ্গু মানুষটার সেবা করে যেতে চাই।’

প্রতিবেশী হারুন অর রশিদ জানান, একজন স্ত্রী তার স্বামীর প্রতি কতটা ভালবাসা, দায়িত্ব ও কর্তব্যপরায়ণ হতে পারে হালিমাকে স্ব-চোখে না দেখলে তা বিশ্বাস করা যাবে না।