জলকষ্টের আর্তনাদ বাগেরহাটের চার উপজেলাজুড়ে

প্রতিনিধি, বাগেরহাট: বাড়ির কাছেই খাল। বাড়ির মধ্যে পুকুর। পানি নেই কোথাও। অথবা যেটুকু আছে তা ব্যবহার করার মতো নয়।

ফিরোজা বেগম গত তিন দিনে একবার মাত্র স্নান করতে পেরেছেন। প্রচণ্ড গরমে হাঁসফাঁস করছেন তিনি। পুকুরের পানি দিন বিশেক আগেই শুকিয়ে গেছে। বাঁধ দেওয়ার কারণে খালে পানি নেই, যেটুকু আছে তা তীব্র লবণাক্ত।

একটু দূরে একটা টিউবওয়েল আছে। সেটাই এখানকার মানুষদের ভরসা। অনেক কষ্টে পানি তুলতে হয়। তাও নোনাস্বাদের। পানি দরকার সবারই। কিন্তু টিউবওয়েলে পানি বেরোয় ক্ষীণধারায়। অনেকক্ষণ লেগে যায় একটা কলসি ভরতে।

Bagerhat water collection from long-distancedr PSF
বহুদূর থেকে এসে কলসি ভরেছে শরণখোলার এসব কিশোরীরা।

রামপাল উপজেলার বারুইপাড়া গ্রামে ফিরোজা বেগমের বাড়ি। তার দুই ছেলে-মেয়ে। ইমরান ও রাবেয়া। মা-মেয়ে গোসলহীন দিন কাটালেও ইমরান প্রতিদিন সাইকেলে তিন কিলোমিটার পাড়ি দিয়ে গোসল করতে যায়।

ফিরোজা বললেন, ‘আমাগো কষ্টের কথা শুনে কী হবে। তিন দিন গোসল করতি পারি না, খরায় সব শুকোয়ে যাচ্ছে, কোনও জায়গায় পানি নেই। লবণ জম্মের বাড়া বাড়িছে। ঘেরের মাছ সব মইরে যাচ্ছে। পানি ব্যাগরে (অভাবে) আমরা মইরে যাব…”

বারুইপাড়ার যার সাথেই কথা হয়, সবারই অবস্থা ফিরোজার মতো। শুধু বারুইপাড়া নয়। গোটা রামপাল জুড়ে দুর্ভোগ-দুর্গতির এরকম বিবর্ণ ছবি। রামপাল উপজেলা চেয়ারম্যান আবু সাঈদের ভাষায়, সব লবণ হয়ে গেছে, পানির খুব অভাব, পুকুর-নালাও শুকোয়ে গেছে, …গরমে ঘেরের মাছও সব মরে যাচ্ছে..রোগ-পীড়ে বাড়তিছে।’

রামপালের মতো বাগেরহাটের দক্ষিণের শরণখোলা, মোড়েলগঞ্জ, মংলা উপজেলায়ও একই দশা। বাগেরহাটের অধিকাংশ এলাকার মানুষ বিশুদ্ধ জলের অভাবে কষ্টের মধ্যে পড়েছেন। দাবদাহের মধ্যে পানির সংকটে তারা ছটফট করছেন। কোথাও কোথাও গোসল ও রান্নার পানিও নেই। এ দুর্ভোগ বর্ণনাতীত। মানুষ বাধ্য হচ্ছে লোনাপানি দূষিত ব্যবহার করতে। এ অবস্থায় পানিবাহিত রোগে আক্রান্তের সংখ্যা বাড়ছে। গত এক মাসে জেলার বিভিন্ন হাসপাতাল ও স্বাস্থ্যকেন্দ্রে এক হাজারের অধিক মানুষ পানিবাহিত রোগে আক্রান্ত হয়ে ভর্তি হয়েছে। যাদের অধিকাংশই শিশু ও বৃদ্ধ।

বাগেরহাটের সিভিল সার্জন ডা. বাকির হোসেন জানান, ‘চলতি শুষ্ক মৌসুমে পানি সংকটের কারণে ডায়রিয়াসহ পানিবাহিত রোগে আক্রান্তের সংখ্যা বাড়তে পারে এমন আশংকার কথা চিন্তা করে  প্রতিটি উপজেলায় একাধিক মেডিক্যাল টিম গঠন করা হয়েছে। মেডিকেল অফিসার, উপসহকারী কমিনিউটি মেডিকেল অফিসার ও স্বাস্থ্য সহকারীর সমন্বয়ে এসব টিম কাজ করছে।’

উপকূলীয় এলাকার এ অঞ্চলে পানি সংকট নিরসনের জন্য ২০০৭ সালের প্রলয়ংণকারী ঘূর্ণিঝড় সিডর পরবর্তীতে সরকারি-বেসরকারি উদ্যোগে বিশুদ্ধ পানি সরবরাহের জন্য সহস্রাধিক গভীর নলকূপ, বৃষ্টির পানি সংরক্ষণাগার ও পুকুরপাড়ে বালির ফিল্টার (পিএসএফ) নির্মাণ করা হলেও তা প্রয়োজনের তুলনায় অপ্রতুল। আবার কাজের মান খারাপ হওয়ায়, পানি শুকিয়ে যাওয়ায় বা পানিস্তর নেমে যাওয়ায় এগুলির অন্তত ৪০ ভাগ ইতোমধ্যে অকেজো হয়ে পড়েছে। পিএসএফগুলোর ৯৫ ভাগই বন্ধ হয়ে গেছে বলে এলাকাবাসী জানিয়েছেন।

উপজেলা জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল অফিস সূত্র জানায়, শুস্ক মৌসুমে পানির স্তর নিচে নেমে যাওয়ার কারণে কোনও কোনও এলাকায় কাঙ্ক্ষিত পানি পাওয়া যাচ্ছে না। আবার কোথাও পানি পাওয়া গেলেও অতিরিক্ত লবণাক্ততার কারণে নতুন করে টিউবয়েল স্থাপন করা যাচ্ছে না।

শরণখোলা উপজেলার পূর্বখাদা গ্রামের ছাত্রী-আসমা আক্তার সুমি (১৪) জানায়, তার বাড়ির কাছাকাছি বিশুদ্ধ পানি না থাকায় প্রতিদিন দেড় কিলোমিটার দূর থেকে পানি সংগ্রহ করতে হয়।

সুন্দরবনসংলগ্ন রাজাপুর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক মো. নজরুল ইসলাম জানান, তার বিদ্যালয়ে বৃষ্টির পানি সংরক্ষণের একটি ট্যাংক ছিল। কিন্তু দুই মাস আগে পানি শেষ হয়ে যাওয়ায় দুর্ভোগে পড়েছেন। শিশুদের খুব কষ্ট হয়।

শরণখোলা ও রামপালের অধিকাংশ ইউপি চেয়ারম্যান জানান, প্রতিটি ইউনিয়নে পিএসএফ গুলো সংস্কার ও গভীর করে পুকুর খনন খুবই জরুরি। নতুবা এ সংকট আরও তীব্রতর হবে বলে তাদের তারা আশংকা করেন।