বাগেরহাট প্রতিনিধি: বাগেরহাটসহ দক্ষিণাঞ্চলে মৎস্য ঘেরে মড়ক শুরু হয়েছে। প্রচণ্ড দাবদাহে ঘের ও পুকুরের পানি অস্বাভাবিক গরম হওয়ার কারণে মাছ মরে যাচ্ছে। সেই সাথে লবণাক্ততা বৃদ্ধি পাওয়ায় বিপর্যয় আরও বাড়ছে। এ পরিস্থিতিতে মৎস্য চাষি ও ঘের মালিকেরা খুবই উদ্বিগ্ন হয়ে পরেছেন। মৎস্য বিভাগ ও পরিবেশ অধিদপ্তর জানিয়েছে, প্রচণ্ড তাপদাহের কারণে এ বিপর্যয়ের সৃষ্টি হয়েছে। বৃষ্টি শুরু না হলে এ অবস্থার উন্নতি হবে না বলে তারা মনে করছেন।

ঘের ও বিল অঞ্চলের বিভিন্ন এলাকা ঘুরে দেখা যায়, অনাবৃষ্টি আর প্রখর তাপে ছোট-বড় জলাশয়গুলোতে পানি কমে গেছে। অত্যধিক দাবদাহে অল্প পানি দ্রুত বেশি উত্তপ্ত হয়ে উঠছে। দিশেহারা চাষিরা তাপমাত্র স্বাভাবিক রাখার জন্য জোয়ারের সময় নদ-নদীর পানি ঘেরে তুলছে। কিন্তু এ পানি অস্বাভাবিক লবণাক্ত হওয়ায় মাছ বাঁচতে পারছে না। অনাবৃষ্টির কারণে নদ-নদীর পানিতেও অস্বাভাবিক লবণাক্ততা বৃদ্ধি পেয়েছে।
মৎস্য চাষিরা জানান, বিগত বছরগুলোর চেয়ে চলতি গ্রীষ্মে তাপমাত্রা অনেক বেশি। দেখা নেই বৃষ্টিরও। ফলে নদ-নদী দিয়ে ঘের ও জলাশয়ে প্রবেশ করা পানিতে বেড়েছে লবণাক্ততা। আর যার প্রভাবে গত প্রায় এক মাস ধরে মাছে মড়ক শুরু হয়েছে। শত চেষ্টা করেও মাছ রক্ষা করা যাচ্ছে না।
মৎস্য বিভাগের তথ্য মতে, বাগেরহাট জেলায় মোট ঘেরের সংখ্যা ৭১ হাজারেরও বেশি। এসব ঘের এবং অধিকাংশ পুকুরে চিংড়ি, রুই, কাতলসহ সব ধরনের সাদা মাছের চাষ হয়। অতিরিক্ত তাপে ঘেরের পানি শুকিয়ে যাওয়ায় পানি অস্বাভিক গরম হয়ে অনেক ঘেরে মাছ মরছে। যে সব ঘেরের গভিরতা বেশি, সেসব ঘেরে মড়কের হার অপেক্ষাকৃত কম বলে মৎস্য কর্মকর্তা নারায়ন মন্ডল উল্লেখ করেন।
সদর উপজেলার কাড়াপাড়া-মিরজাপুর মৎস্যজীবী সমবায় সমিতির সাধারণ সম্পাদক আলমগীর হোসেন জানান, প্রচণ্ড গরম আর পানিতে অস্বাভাবিক লবণাক্ততার কারণে তার ৫টি ঘেরের প্রায় সব সাদা মাছসহ চিংড়ি মরে যাচ্ছে। ইতোমধ্যে তাদের ১’শ একর জমির ঘেরের অন্তত: বিশ লাখ টাকার মাছ মরে গেছে। গত মে মাসের মাঝামাঝি সময় থেকেই এই এলাকার ঘেরগুলোতে মাছ মরতে শুরু করেছে। প্রায় সব ঘেরেই মাছ মরছে। অত্যধিক গরম এবং বৃষ্টি না হওয়াতে পানিতে লবণাক্ততা বেড়ে গিয়ে এ অঞ্চলের সব মৎস্য ঘেরের একই দশা বলেও জানান তিনি।
তিনি আরও জানান, সাধারণভাবে সব ধরনের মাছ চাষের জন্য ঘেরের পানিতে ৬, ৭ ও ৮ মাত্রার পিপিটি (লবণাক্ততা পরিমাপের হার) থাকা ভালো। কিন্তু বর্তমানে তা বেড়ে ১৮ থেকে ২০ এর কাছাকাছি রয়েছে। এছাড়া যেখানে পিএস কোনো অবস্থাতেই ১০-১২ এর উপরে যাওয়া উচিত নয়, তাও এখন ১৬ এর উপরে।
ঘের কর্মচারী নিপুণ সাহা জানান, তিনি ১৪ বছর ধরে ঘেরের কাজ করছেন। এ যাবৎ এমন বিপর্যয় দেখেননি। বৃষ্টি নেই। সব ঘেরে মাছ মরে যাচ্ছে। অনেক ঘেরের মালিক কর্মচারীদের ছেড়ে দিচ্ছেন।
বাসার আমিন কর্মকার জানান, দাগের হুলা মৌজার অসীম সিকদারের মৎস্য ঘেরে তিনি কাজ করতেন। কিন্তু ঘেরের মাছ মরতে শুরু করায় ও লোকসান কাটিয়ে উঠতে না পারায় তিন দিন আগে তাকে ছাঁটাই করে দিয়েছেন মালিক।
৩০ বছর ধরে মাছ চাষে জড়িত বাগেরহাটেরে রামপাল সদর ইউপি চেয়ারম্যান শেখ বজলুর রহমান ও সদর উপজেলার কাড়াপাড়ার মৎস্য চাষি শেখ আবুল হোসেন বলেন, বিষ লবণে সব মাছ মরে যাচ্ছে। আগেও এই এলাকায় লবণ ছিল, কিন্তু এবার পানিতে লবণের পরিমাণ অনেক বেশি। তাই সব মাছ মরে ভেসে উঠছে। গাছগুলোও মরে যাচ্ছে। তাঁদের ভাষায়, এমন অবস্থা চলতে থাকলে শুধু মাছ নয়, সব মরে যাবে।
বাগেরহাট জেলা চিংড়ি চাষি সমিতির আহ্বায়ক ফকির মহিদুল ইসলাম সুমন জানান, গরম আর লবণে সব মাছ মরে ভেসে উঠছে। জেলার অধিকাংশ ঘেরগুলোর চিত্রই এমন। অনেক স্থানে বিশেষ করে বসতবাড়ির পুকুরে পানি ঠান্ডা রাখতে নারকেল-সুপারির পাতা দিয়ে মাঁচা তৈরি করা হচ্ছে। তবে এতেও তাপ থেকে মাছকে বাঁচানো যাচ্ছে না।
গেল হরতাল-অবরোধের কারনে চিংড়িসহ মাছের ন্যায্য দাম পায়নি চাষিরা। এবার মৌসুমের শুতেই এমন মড়কে চাষিরা দিশেহারা বিপর্যস্থ হয়ে পড়েছেন।
জেলা মৎস্য কর্মকর্তা নারায়ন চন্দ্র মন্ডল বলেন, তাপ মানে তো পরিবেশ বিপর্যয়। যে পরিমাণে রোদ ও ঘেরে পানি কম, কিছু মাছ তো মারা যাবেই। দেখা যাচ্ছে ৪ ইঞ্চি, ৮ ইঞ্চি পানি। এর মধ্যে মাছ বাঁচিয়ে রাখা কঠিন। বৃষ্টি হচ্ছে না। লবণাক্ততার কারনে নয়, অত্যাধিক রোদের কারণেই এমন অবস্থার সৃষ্টি হয়েছে বলে তিনি উল্লেখ করেন। তাঁর মতে, বৃষ্টি ছাড়া এই বিপর্যয় কাটিয়ে ওঠা দুস্কর।