শেরপুর থেকে এম. সুরুজ্জামান: শেরপুরের নালিতাবাড়ী উপজেলায় ২০১৫ সালে সরকারিভাবে বোরো মৌসুমের চাল সরবরাহে খাদ্য নিয়ন্ত্রক, মিল মালিক সমিতির সভাপতি ও সরকারদলীয় কতিপয় নেতার বিরুদ্ধে ব্যাপক অনিয়ম ও দুর্নীতির অভিযোগ উঠেছে। এসব অনিয়মের তদন্ত চেয়ে খাদ্য অধিদপ্তরের মহাপরিচালকের কাছে আবেদন জানিয়েছেন মিল মালিকরা।
উপজেলা খাদ্যগুদাম সূত্রমতে, চলতি বছর উপজেলায় ১০৪টি লাইসেন্সধারী রাইছ মিলের বিপরীতে সরকারিভাবে মোট ৫ হাজার ৯০৫ মেট্টিকটন চাল সংগ্রহের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়। এরমধ্যে প্রথম দুই দফায় ৪৭টি এবং দ্বিতীয় দুই দফায় ৩২টি সর্বমোট চার দফায় ৭৯টি মিল সরকারের সঙ্গে চুক্তিবদ্ধ হয়।
তথ্যানুসন্ধানে জানা গেছে, সরকারের নীতিমালা মেনে প্রথম দফায় বেশিরভাগ মিল চুক্তিবদ্ধ করা হলেও পরবর্তী দফায় চুক্তিবদ্ধ ৩২টি মিলের মধ্যে ১৬টিই বন্ধ ও বেশিরভাগ পরিত্যক্ত। রাজনৈতিক ও ব্যক্তিগত প্রভাব এবং মিল মালিকের কাছ থেকে মোটা অংকের ঘুষ এবং কমিশন নিয়ে এগুলো চুক্তির আওতায় আনা হয়েছে। সরেজমিনে দেখা গেছে, মিল মালিক সমিতির সভাপতি মোস্তাফিজুর রহমান মুকুলের মালিকানাধীন শহরের গড়কান্দায় অবস্থিত নির্মাণাধীন মুমু চাউলকলটি এখনও নির্মাণাধীন। অথচ গত ৩ জুন এ চাউল কলের নামে ২০ মেট্টিকটন চাল গুদামে সরবরাহ করা হয়েছে। রানীগাঁওয়ে অবস্থিত জান্নাত চাউল কলটি প্রায় পাঁচ বছর যাবত পরিত্যক্ত। আর্থিক দৈন্যতায় দীর্ঘদিন যাবত বন্ধ রয়েছে রানীগাঁওয়ের লিয়াকত চাউল কল। বর্তমান উপজেলা আ’লীগের সাধারণ সম্পাদক ফজলুর রহমান নিজে ওই মিল দুটির নামে চাল সরবরাহ করতে মালিকদের কাছ থেকে গোপনে চুক্তি নিয়ে গত ৩১ মে এ দু’টিকে সরকারের সঙ্গে চুক্তিবদ্ধ করিয়েছেন। বিষয়টি গণমাধ্যমের কাছে স্বীকারও করেছেন মিল মালিক লিয়াকত আলী।
এছাড়াও দীর্ঘদিন যাবত পরিত্যক্ত ও বন্ধ হলেও ঘুষ এবং কমিশনের শর্তে সরকারের সঙ্গে চুক্তিবদ্ধ হয়েছে, শাহ পরান রাইছ মিল, মা চাউল কল, রিজু রাইছ মিল, রুবেল রাইছ মিল, শাপলা রাইছ মিল, নূর চাউল কল, মজিদ চাউল কল, জুয়েল চাউল কল, জোবায়ের চাউল কল, নিউ মদিনা চাউল কল, হাবিব চাউল কল, মা চাউল কল, নিউ আল-আমিন চাউল কল, সততা চাউল কল ও জায়েদা চাউল কল।
এদিকে বারবার দেন-দরবার করার পরও এককালীন ঘুষ ও টনপ্রতি কমিশন না পাওয়ায় চুক্তির বাইরে রাখা হয়েছে- আলী এন্ড মেরিনা চাউল কল, মা জয়লক্ষèী চাউল কল, রিয়াদ চাউল কল, রুমেছা চাউল কল, গোবিন্দ চাউল কল, মাধু রাইছ মিল, রোকেয়া চাউল কল, মঈন চাউল কল, মিনারা চাউল ও বাবুল চাউল কল।
নালিতাবাড়ী রাইছ মিল মালিক সমিতির সাবেক সভাপতি ও মা জয়লক্ষèী রাইচ মিলের স্বত্ত্বাধিকারী অসীম দত্ত হাবলু জানান, আমার মোট তিনটি রাইছ মিল রয়েছে। ২০০০ সাল থেকে এসব মিল সরকারের সাথে চুক্তিবদ্ধ হয়ে চাউল সরবরাহ করে আসছি। অথচ এ বছর আমার একটি মিল চুক্তির বাইরে রাখা হয়েছে।
রিয়াদ চাউল কলের স্বত্ত্বাধিকারী গোলাম মোস্তফা জানান, আমাদের ৮ জন মিল মালিকের কাছে প্রথমে ১৩ হাজার ও পরে ১০ জনের কাছে ১ লাখ টাকা করে খাদ্য নিয়ন্ত্রকের জন্য ঘুষ দাবি করেন মিল মালিক সমিতির সভাপতি।
রোকেয়া চাউল কলের তত্ত্বাবধায়ক মনিরুজ্জামান সোহাগ জানান, প্রথমে দাবি অনুযায়ী আমি ১৩ হাজার টাকা দেই। পরবর্তীতে এ টাকা ফেরত দেওয়া হয়। এদিকে মিল মালিক সমিতির সভাপতি মুকুল আমার কাছে খাদ্য নিয়ন্ত্রকের জন্য প্রতিটনে ২ হাজার করে টাকা দাবি করে বলেন, ‘এছাড়া তোমার মিলটি চুক্তি করা যাচ্ছে না’।
নালিতাবাড়ী মিল মালিক সমিতির সভাপতি মোস্তাফিজুর রহমান মুকুল লেনদেনের বিষয়টি অস্বীকার করে জানান, তদন্ত কমিটি সরেজমিনে পরিদর্শন করে অবকাঠামোগত বিষয়ের আলোকে ১০টি মিলকে একাধিক লাইসেন্সধারী বলে সনাক্ত করে। ফলে তাদের চুক্তির আওতায় আনা হয়নি।
উপজেলা খাদ্য নিয়ন্ত্রক আব্দুল বাতেনের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তিনি বলেন, পাঁচ সদস্যের তদন্ত কমিটির প্রতিবেদনের আলোকে মিল চুক্তিবদ্ধের সুপারিশ করা হয়েছে। এক্ষেত্রে আমি ওই কমিটির সদস্য সচিব মাত্র। কাজেই আমার পক্ষে এসব অনিয়ম করা সম্ভব নয়।
এদিকে তদন্তপূর্বক প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়ার আবেদন জানিয়ে গত ৭ জুন খাদ্য অধিদপ্তরের মহাপরিচালক বরাবর অভিযোগ দাখিল করেছেন বঞ্চিত মিল মালিকরা।