মৌলভীবাজার থেকে আজিজুল ইসলাম: মাগুরছড়া গ্যাস কূপ ট্র্যাজেডির ১৮ বছর পূর্ণ হচ্ছে আজ ১৪ জুন। ১৯৯৭ সনের এইদিনে কমলগঞ্জ উপজেলার মাগুরছড়া গ্যাস কূপে অক্সিডেন্টাল কোম্পানির ড্রিলিং চলাকালে ভয়াবহ বিস্ফোরণে বন, পরিবেশ, জীববৈচিত্র্য, রেল ও সড়কপথ, পানজুম, বিদ্যুৎ লাইনসহ এলাকার ব্যাপক ক্ষতি হয়। অক্সিডেন্টাল ক্ষয়ক্ষতির আংশিক পরিশোধ করলেও বন বিভাগ কোনো ক্ষতিপূরণ পায়নি। ফিরে আসেনি এখনও প্রাকৃতিক বনের স্বাভাবিক পরিবেশ।
পূর্ণ ক্ষতিপূরণ না দিয়েই ইউনিকলের কাছে হস্তান্তরের পর সর্বশেষ শেভরনের কাছে গ্যাস ফিল্ড বিক্রি করেছে অক্সিডেন্টাল। শেভরন ২০০৮ সালে ওই বনে ত্রি-মাত্রিক ভূ-তাত্ত্বিক জরিপের কাজ সম্পন্ন করে। এতেও স্থানীয়ভাবে অনেকেই ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন। ২০১২ সনে শেভরন মৌলভীবাজার ১৪নং ব্লকের অধীনে নূরজাহান, ফুলবাড়ি এবং জাগছড়া চা বাগানের সবুজ বেষ্টনী কেটে কূপ খননের পর এসব কূপ থেকে চা বাগানের ভেতর দিয়ে ড্রেন খনন করে পাইপ লাইনের মাধ্যমে উত্তোলিত গ্যাস কালাছড়ার মাধ্যমে রশীদপুর গ্রিডে স্থানান্তর চলছে।
অনুসন্ধানে দেখা যায়, মাগুরছড়ায় অক্সিডেন্টালের গ্যাস কূপ খননের সময় ভয়াবহ দুর্ঘটনার ক্ষয়ক্ষতি কাটিয়ে উঠেনি। ২০০৮ সালে মাগুরছড়া ও লাউয়াছড়ায় শেভরন ত্রিমাত্রিক ভূতাত্ত্বিক জরিপ কাজ সম্পন্নকালে বিভিন্ন এলাকার ব্যাপক ক্ষতি হয়। লাউয়াছড়া ফরেস্ট বিটের অভ্যন্তরে মাগুরছড়া এলাকায় ১৯৮৪-৮৬ ও ১৯৯৪ সালে দায়িত্ব পায় যুক্তরাষ্ট্রের তেল গ্যাস উত্তোলনকারী অক্সিডেন্টাল কোম্পানি। দায়িত্ব গ্রহণের পর অক্সিডেন্টাল গ্যাস ফিল্ডের ড্রিলিং কাজের জন্য সাবলিজ প্রদান করে ডিউটেক নামের জার্মান কোম্পানিকে। ১৪নং ব্লকের মাগুরছড়াস্থ মৌলভীবাজার-১ গ্যাসকূপের খননকালে ১৪ জুন মধ্যরাত ১টায় ভয়াবহ বিস্ফোরণ ঘটে। বিস্ফোরণে প্রত্যক্ষভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয় ৬৯৫ হেক্টর বনাঞ্চলের পরিবেশের জীববৈচিত্র্য, রেল ও সড়কপথ, ফুলবাড়ি চা বাগান, খাসিয়া পুঞ্জির বাড়িঘর ও পান জুম, পিডিবির ৩৩ হাজার বিদ্যুৎ লাইন। পরোক্ষভাবে ২৮টি চা বাগানসহ এলাকায় ব্যাপক ক্ষতি হয়। এছাড়া ২শ বিলিয়ন ঘনফুট গ্যাস পুড়ে নষ্ট হয়, যার বাজার মূল্য ৫০ কোটি ডলার। দুর্ঘটনার দুই বছরের মধ্যে ফুলবাড়ি চা বাগানের ক্ষতিগ্রস্ত টি প্লান্টেশন এলাকার ক্ষতিপূরণ, খাসিয়া পুঞ্জির ক্ষয়ক্ষতি বাবদ ২ কোটি ৫ লাখ টাকা দাবির মধ্যে ৫০ লাখ টাকা ও বাস মালিক সমিতিকে ২৫ লাখ টাকা প্রদান করা হয়।
দুর্ঘটনার ১৮ বছর অতিবাহিত হলেও এখন পর্যন্ত পরিপূর্ণ ক্ষতিপূরণ দেওয়া হয়নি রেল সেকশন, ক্ষতিগ্রস্ত বন, পরিবেশ ও জীব বৈচিত্র্যের জন্য। বন বিভাগের হিসাবমতে প্রত্যক্ষ ক্ষতি ৩২ দশমিক ৫৩ কোটি এবং অন্যান্য ক্ষতি মিলিয়ে মোট ১৭৬ দশমিক ৯৭ কোটি টাকা। এই সময়ে পরিবেশ মন্ত্রণালয় পুরো হিসাব মিলিয়ে ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ ৬০৯ কোটি টাকা নিরূপণ করে অক্সিডেন্টালের কাছে দাবি জানায়। দুর্ঘটনার সময়ে তৎকালীন আওয়ামী লীগ সরকারের খনিজ ও জ্বালানি মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব মাহফুজুল ইসলামকে প্রধান করে একটি তদন্ত কমিটি গঠন করার পর কমিটি ১৯৯৭ সালের ৩০ জুলাই মন্ত্রণালয়ে রিপোর্ট পেশ করেছিল। তাদের রিপোর্টে অক্সিডেন্টালের দায়িত্বহীনতাকেই দায়ী করা হয়।
মাগুরছড়া খাসিয়া পুঞ্জির মন্ত্রী জিডিসন প্রধান সুচিয়ান জানান, এ ঘটনার মধ্যদিয়ে প্রাকৃতিক বনের যে কি পরিমাণ ক্ষতি হয়েছে তা কেউ বুঝতে পারবে না। আমরা যারা এই বনে বসবাস করছি তারা বুঝতে পারছি।
সিলেট বিভাগীয় বন কর্মকর্তা (বন্যপ্রাণী) মাহবুবুর রহমান জানান, বনের ১৭৭ কোটি টাকার ক্ষতি নিরূপণ করে দেওয়া হলেও এ পর্যন্ত কিছুই পাওয়া যায়নি। তিনি বলেন, প্রাকৃতিক বনের ক্ষতি কোনো সময় পুষিয়ে উঠার নয়।