জামায়াতে ইসলামীর সেক্রেটারি জেনারেল আলী আহসান মোহাম্মাদ মুজাহিদের মৃত্যুদণ্ড বহাল রেখেছেন দেশের সর্বোচ্চ আদালত। মুক্তিযুদ্ধকালে মানবতাবিরোধী অপরাধের দায়ে তাকে এই সাজা দেওয়া হয়েছিল।
প্রধান বিচারপতি সুরেন্দ্র কুমার সিনহার নেতৃত্বাধীন আপিল বিভাগের চার সদস্যের বেঞ্চ মঙ্গলবার সকালে এ রায় দেন। আজকের কার্যতালিকার ১ নম্বরে ছিল মুজাহিদের রায় ঘোষণার বিষয়টি। বেঞ্চের অপর সদস্যরা হলেন বিচারপতি নাজমুন আরা সুলতানা, বিচারপতি সৈয়দ মাহমুদ হোসেন ও বিচারপতি হাসান ফয়েজ সিদ্দিকী।
জামায়াতের গুরুত্বপূর্ণ নেতা মুজাহিদ বিগত চারদলীয় জোট সরকারের সমাজকল্যাণ মন্ত্রী ছিলেন। ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধকালে বুদ্ধিজীবী হত্যাকাণ্ডের দায়ে প্রথম সর্বোচ্চ সাজা পান মুজাহিদ।
২০১৩ সালের ১৭ জুলাই আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-২ মানবতাবিরোধী অপরাধের দায়ে মুজাহিদকে মৃত্যুদণ্ডাদেশ দিয়ে রায় ঘোষণা করেন। তাঁর বিরুদ্ধে রাষ্ট্রপক্ষের আনা সাতটি অভিযোগের মধ্যে পাঁচটি প্রমাণিত হয়। ২০১৩ সালের ১১ আগস্ট ট্রাইব্যুনালের ওই রায়ের বিরুদ্ধে সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগে আপিল করেন মুজাহিদ। চলতি বছরের ২৯ এপ্রিল আপিল বিভাগে ওই আপিলের শুনানি শুরু হয়। নয় কার্যদিবস ধরে চলা শুনানির প্রথম ছয় দিন ট্রাইব্যুনালের রায় ও সাক্ষ্য-প্রমাণ উপস্থাপন করে আসামিপক্ষ। এরপর তিন কার্যদিবসে রাষ্ট্রপক্ষ ও আসামিপক্ষের পাল্টাপাল্টি যুক্তি উপস্থাপনের মধ্য দিয়ে ২৭ মে মামলার কার্যক্রম শেষ হয়। ওই দিনই ১৬ জুন (আজ) রায়ের দিন ধার্য করেন আপিল বিভাগ।
প্রসিকিউশনের আনা সাতটি অভিযোগের মধ্যে প্রথম অভিযোগে সাংবাদিক সিরাজুদ্দীন হোসেনকে অপরণের পর হত্যা এবং ষষ্ঠ অভিযোগে বুদ্ধিজীবীসহ গণহত্যার ষড়যন্ত্র ও ইন্ধনের অভিযোগে ফাঁসিতে ঝুলিয়ে ওই দণ্ড কার্যকর করার আদেশ দিয়েছিল বিচারিক আদালত।
একই রায় এসেছিল সপ্তম অভিযোগে, ফরিদপুরের বকচর গ্রামে হিন্দু সম্প্রদায়ের ওপর বর্বর হামলা চালিয়ে হত্যা-নিযার্তনের ঘটনায়।
আপিল বিভাগের রায়ে প্রথম অভিযোগে আসামির আপিল মঞ্জুর করে তাকে খালাস দেওয়া হয়েছে। সপ্তাম অভিযোগে তার সাজা কমিয়ে দেওয়া হয়েছে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড।
আর ষষ্ঠ অভিযোগে বুদ্ধিজীবী হত্যার দায়ে ট্রাইব্যুনালের রায় বহাল রেখে মুজাহিদের ফাঁসির আদেশ দিয়েছে সর্বোচ্চ আদালত।
পঞ্চম অভিযোগে সুরকার আলতাফ মাহমুদ, গেরিলা যোদ্ধা জহিরউদ্দিন জালাল ওরফে বিচ্ছু জালাল, শহীদজননী জাহানারা ইমামের ছেলে শাফি ইমাম রুমি, বদিউজ্জামান, আবদুল হালিম চৌধুরী জুয়েল ও মাগফার আহমেদ চৌধুরী আজাদসহ কয়েকজনকে ঢাকার নাখালপাড়ায় পুরনো এমপি হোস্টেলে আটকে রেখে নির্যাতন এবং জালাল ছাড়া বাকিদের হত্যার ঘটনায় সংশ্লিষ্টতার জন্য ট্রাইব্যুনালে মুজাহিদকে দেয়া হয়েছিল যাবজ্জীবন কারাদণ্ড। আপিল বিভাগের রায়ে সেই সাজাই বহাল রাখা হয়েছে।
ট্রাইব্যুনালের রায়ে তৃতীয় অভিযোগে ফরিদপুর শহরের খাবাসপুরের রণজিৎ নাথকে অপহরণ ও নির্যাতনের ঘটনায় পাঁচ বছরের কারাদণ্ড দেওয়া হয় মুজাহিদকে। ওই সাজা তার প্রাপ্য বলে আপিল বিভাগও মনে করেছে।
এছাড়া দ্বিতীয় অভিযোগে ফরিদপুরের চরভদ্রাসনে হিন্দু গ্রামে গণহত্যা এবং চতুর্থ অভিযোগে আলফাডাঙ্গার আবু ইউসুফ ওরফে পাখিকে আটকে রেখে নির্যাতনের ঘটনার সত্যতা পাওয়া গেলেও তাতে মুজাহিদের সংশ্লিষ্টতা প্রসিকিউশন প্রমাণ করতে না পারায় ট্রাইব্যুনাল মুজাহিদকে খালাস দিয়েছিল। এ কারণে এ দুটি অভিযোগ আপিল বিভাগের রায়ে বিবেচনায় নেওয়া হয়নি।
২০১০ সালে যুদ্ধাপরাধের বহু প্রতীক্ষিত বিচার শুরুর পর যুদ্ধাপরাধ ট্রাইব্যুনালে দণ্ডিতদের মধ্যে মুজাহিদ হলেন চতুর্থ ব্যক্তি, আপিল বিভাগে যার মামলার নিষ্পত্তি হল।
২১ অগাস্ট গ্রেনেড মামলায় হাজিরার জন্য মুজাহিদকে আগের দিন নারায়ণগঞ্জ থেকে ঢাকায় নিয়ে আসা হয়েছিল। আপিল বিভাগ যখন যুদ্ধাপরাধ মামলার চূড়ান্ত রায় ঘোষণা করছে, ৬৭ বছর বয়সী এই জামায়াত নেতা তখন ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে।
মুক্তিযুদ্ধকালীন আলবদর বাহিনীর কমান্ডার আলী আহসান মোহাম্মদ মুজাহিদের ফাঁসির রায় বহাল থাকায় আদালতের বাইরে এ মামলার সাক্ষী ও মুক্তিযোদ্ধারা সন্তোষ প্রকাশ করেন।