প্রতিনিধি, খুলনা: নারায়ণগঞ্জের বহুল আলোচিত সাত খুনের আসামি লেফটেন্যান্ট কমান্ডার (অব.) এম এম রানার পরিবার দাবি করেছেন যে, এই হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে এম এম রানা জড়িত নন। তিনি শুধু র্যাবের একটি আনুষ্ঠানিক গ্রেফতার অভিযানে সহায়তা করেছেন। কিন্তু তাকে বাধ্যতামূলক অবসরে পাঠানোর পাশাপাশি প্রাপ্য সকল সুযোগ-সুবিধা থেকে বঞ্চিত করা হচ্ছে। এমনকি ন্যায়বিচার থেকেও বঞ্চিত হচ্ছেন তিনি।
শনিবার দুপুরে খুলনা প্রেসক্লাবে এক সংবাদ সম্মেলনে এসব দাবি করেন এম এম রানার স্ত্রী নুর-এ-হাফজা। সংবাদ সম্মেলনে জানানো হয়, সাড়ে তিন বছরের কন্যাকে নিয়ে রানার স্ত্রী নুর-এ-হাফজা আত্মীয়স্বজনের দ্বারস্থ হয়েছেন। রানার ছোট ভাইয়ের পড়াশুনা বন্ধের পথে। বৃদ্ধ মা যেমন সন্তানের এ দুরাবস্থায় পাগলপ্রায়। তার একমাত্র শিশু সন্তানটিও পিতার স্নেহ-মমতা থেকে বঞ্চিত। তার ভবিষ্যত নিয়েও দেখা দিয়েছে শংকা।
এ অবস্থায় রানার পরিবার সুবিচার চেয়েছে। এজন্য প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সরাসরি হস্তক্ষেপ কামনা করেছেন তারা।
লিখিত বক্তব্যে নুর-এ-হাফজা বলেন, নারায়ণগঞ্জের মর্মান্তিক হত্যাকাণ্ডের ঘটনাটি দীর্ঘ এক বছর তদন্তের পর তদন্তকারী কর্মকর্তা কোনোরূপ সাক্ষ্য-প্রমাণ ব্যতীত এম এম রানাকে কথিত অপহরণের সহযোগিতার অভিযোগ এনে আসামি করেন। তিনি দাবি করেন, এলিট ফোর্স র্যাবের চেইন অব কমান্ড এবং অফিস আদেশ মেনেই দায়িত্ব পালন করেন রানা। ফৌজদারি কার্যবিধির ১৬৪ ধারায় প্রদত্ত জবানবন্দিতেও এম এম রানা নিজেকে জড়িয়ে অপহরণ ও হত্যার সহায়তার দোষ স্বীকার করেননি। কমান্ডিং অফিসার লে. কর্নেল তারেক সাঈদ ও অপারেশন অফিসার মেজর আরিফও তাদের জবানবন্দিতে রানাকে জড়িয়ে কোনো বক্তব্য দেননি। তাহলে কেন একজন নিরপরাধ ব্যক্তিকে কারাবন্দি রেখে পুরো পরিবারটিকে ধ্বংসের দিকে ঠেলে দেওয়া হচ্ছে এমন প্রশ্নও করেন রানার স্ত্রী।
নারায়ণগঞ্জের যে ঘটনাকে কেন্দ্র করে আজ রানার এই পরিণতি সেই অপারেশন সম্পর্কে রানার স্ত্রী বলেন, র্যাবের মতো একটি সুশৃঙ্খল বাহিনীকে চেইন অব কমান্ড অনুসারে কাজ করতে হয়। ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের গ্রেফতারের মতো বৈধ আদেশ অধীনস্থদের অমান্য করার কোনো সুযোগ নেই। নারায়ণগঞ্জের ওই গ্রেফতারের আদেশটি অধিনায়ক লে. কর্নেল তারেক সাঈদ কোম্পানি কমান্ডারদের সম্মেলনে অপারেশন অফিসার হিসেবে মেজর আরিফের ওপর দায়িত্ব দেন। কারণ কাউন্সিলর নজরুল ইসলাম সিদ্দিরগঞ্জ থানার অধিবাসী। এলাকাটি মেজর আরিফের দায়িত্ব-এলাকার অন্তর্ভুক্ত। তাছাড়া ২০১৪ সালের ২৭ এপ্রিল সকাল সাড়ে ১০টা থেকে বেলা সোয়া ১২টা পর্যন্ত লে. কমান্ডার এম এম রানা তার দায়িত্বের আওতাভুক্ত এলাকা চাষাড়া সংলগ্ন আর্মি মার্কেটের সামনে নিজস্ব অপারেশনশেষে কালীবাজার ক্যাম্পে আসামি ও উদ্ধারকৃত মালামাল রেখে সিও-র নির্দেশে মেজর আরিফের অভিযানে সহায়তা করেন মাত্র। এ ক্ষেত্রে কাউন্সিলর নজরুল ইসলামকে গ্রেফতারে মেজর আরিফকে সহায়তা না করলে ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের আদেশ অমান্য করার অপরাধে সার্ভিস রুল অনুযায়ী কোর্ট মার্শাল অথবা বড় ধরনের শাস্তি হতো এম এম রানার। তাছাড়া প্রকাশ্য দিবালোকে চেকপোস্ট বসিয়ে আসামি গ্রেফতারের পর তাকে নিয়ে এমন ‘অপহরণ’ গল্প তৈরি হবে এমন ধারণাও রানার থাকার কথা নয়। ওই সাতজন আসামি কেউ রানার আসামি নয় বা তার এলাকার আসামিও নয়। তাই গ্রেফতারের পর তাদের মেজর আরিফ কোথায় নিয়ে যাবেন সেটি লে. কমান্ডার এম এম রানার জানার কথা নয়। কিন্তু ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের নির্দেশ পালনে শুধুমাত্র গ্রেফতার অভিযানে সয়াহতা দিয়েই এখন প্রায় দেড় বছর ধরে কারাবন্দি থাকতে হচ্ছে নিরপরাধ রানাকে।
সংবাদ সম্মেলনে আরও বলা হয়, কাউন্সিলর নজরুল ইসলামকে গ্রেফতারের বিষয়টি ছিল র্যাবের একটি নিয়মিত প্রক্রিয়া। যেটি সম্পন্ন হয়েছে সিও তারেক সাঈদের নির্দেশে এবং মেজর আরিফের নেতৃত্বে। গ্রেফতারের পর লে. কমান্ডার এম এম রানার কাছে আসামি রাখাও হয়নি। ওই অভিযানের পূর্ব ও পরবর্তী মোবাইল রেকর্ডিংও তার জ্বলন্ত সাক্ষী। কিন্তু রানাকে এ মামলায় জড়িয়ে হয়রানি করা হচ্ছে বলেও অভিযোগ করেন তারা।
সংবাদ সম্মেলনে রানার স্ত্রী আরও অভিযোগ করেন বলেন, তার স্বামী বাংলাদেশ নৌ বাহিনীর একজন অফিসার। কিন্তু তাকে কোনোপ্রকার আত্মপক্ষ সমর্থনের সুযোগ না দিয়ে বেআইনিভাবে বাধ্যতামূলক অবসরে পাঠানো হয়। যা বাংলাদেশের সংবিধানে প্রদত্ত অধিকার ও নৌবাহিনী আইনের পরিপন্থি বলেও তিনি দাবি করেন। একজন সামরিক বাহিনীর সদস্য হিসেবে সর্বপ্রথম বোর্ড অব ইনকোয়ারি এবং সর্বশেষ কোর্ট মার্শাল করার বিধান থাকলেও তার স্বামীর ক্ষেত্রে সেটি করা হয়নি। নুর-এ-হাফজা উল্লেখ করেন, এম এম রানা বাংলাদেশ নৌবাহিনীর ওসমানী স্বর্ণপদকপ্রাপ্ত কমিশন্ড অফিসার।
রানার স্ত্রী বলেন, তার স্বামী সকল প্রকার ন্যায়বিচার বঞ্চিত হয়েছেন এবং উচ্চ আদালতেও তার জামিনের শুনানিতে অপারগতা প্রকাশ করা হয়। যা ফৌজদারি কার্যবিধি ও সংবিধান পরিপন্থি বলেও তিনি দাবি করেন।
রানার বর্তমান পারিবারিক অবস্থা তুলে ধরে সংবাদ সম্মেলনে বলা হয়, পিতার মৃত্যুর পর রানাই তার পরিবারের একমাত্র উপার্জনক্ষম ব্যক্তি। তার আয়ের ওপরই বিধবা মায়ের ভরণপোষণ আর ভাইয়ের লেখাপড়া চলত। কিন্তু তার এ করুণ পরিণতির পর চাকরির সকল সুযোগ-সুবিধা থেকেও বঞ্চিত করা হয়েছে। এমনকি বাধ্যতামূলক অবসর দেওয়া হলেও এলপিআরের টাকাও দেয়া হয়নি। যে কারণে রানার পরিবারের সদস্যদের একটি অন্ধকার ভবিষ্যতের দিকে ধাবিত হতে হচ্ছে।
সংবাদ সম্মেলন থেকে রানার পরিবার যাতে ন্যায় বিচার পায় সেজন্য প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাসহ সংশ্লিষ্ট সকলের সহায়তা কামনা করা হয়। এসময় রানার বৃদ্ধ মাতা কোহিনুর বেগম, কন্যা মারিয়া আলভিনা, শ্বশুর এসএম জামাল উদ্দিন এবং সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী ফরহাদ আব্বাস উপস্থিত ছিলেন।