প্রতিনিধি, খুলনা: খুলনায় এক শিশু শ্রমিকের মলদ্বারে কমপ্রেসার মেশিন দিয়ে বাতাস ঢুকিয়ে তাকে নির্মমভাবে হত্যা করেছে শিশুটির সাবেক নিয়োগকর্তা। পৈশাচিক নির্যাতনে শিশু রাজনের অকালমৃত্যুর ক্ষত শুকাতে না শুকাতে এবার নির্যাতনে প্রাণ গেল খুলনার শিশু রাকিবের (১২)। এক কর্মস্থল ছেড়ে অন্য কর্মস্থলে যোগ দেওয়ার ‘অপরাধে’ তাকে নির্মমভাবে হত্যা করা হলো।
রাকিবের মলদ্বারে কমপ্রেসার মেশিন বসিয়ে পেটে বাতাস ঢুকিয়ে নির্যাতন করেছে মোটরসাইকেল গ্যারেজ মালিক শরীফ ও তার সহযোগী মিন্টু এমন অভিযোগ উঠেছে। নিহত রাকিব নগরীর টুটপাড়া সেন্ট্রাল রোডের দিনমজুর আলম হাওলাদারের ছেলে। ঘটনার পর স্থানীয় জনগণ তিনজনকে গণধোলাই দিয়ে পুলিশে সোপর্দ করেছে।
খুলনা মেডিকেল কলেজের চিকিৎসকের বরাত দিয়ে খুলনা থানার অফিসার ইনচার্জ সুকুমার বিশ্বাস জানান, রাকিবের শরীরে অস্বাভাবিক পরিমাণ হাওয়া প্রবেশ করানোর কারণে তার পেটের নাড়িভুড়ি ছিড়ে যায়, ফুসফুস ফেটে যাওয়াসহ শরীরের বিভিন্ন অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ অকেজো হয়ে যায়। ফলে সে মারা যায়।
নিহত রাকিবের পিতা আলম হাওলাদার ও খালা পারুল বেগম বলেন, সোমবার (৩ আগস্ট) নগরীর টুটপাড়াস্থ শরীফের মোটরসাইকেল গ্যারেজে মালিক শরীফ ও তার সহযোগী মিন্টু রাকিবের মলদ্বারে মোটরসাইকেলে হাওয়া দেওয়ার পাইপ ঢুকিয়ে হাওয়া দেয়। পেটে হাওয়া দেওয়ায় রাকিবের পেট ফুলে অজ্ঞান হয়ে গেলে শরীফ ও মিন্টু মিলে তাকে খুলনা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে (খুমেক) ভর্তি করে এবং আমাদের খবর দেয়। খুমেকের কর্তব্যরত চিকিৎসক জানান, রাকিব জীবন-মরণের সন্ধিক্ষণে আছে। তার চিকিৎসা এখানে সম্ভব নয়। এরপর রাকিবকে নিয়ে ঢাকা রওনা হলে পথে সে মারা যায়।
নির্যাতনের খবর ছড়িয়ে পড়লে এলাকাবাসী এক নারীসহ শরীফ ও তার ভাই মিন্টুকে গণপিটুনি দেয়। পুলিশ আশংকাজনক অবস্থায় তাদের উদ্ধার করে খুমেক হাসপাতালে নিয়ে যায়।
এলাকাবাসী জানান, রাকিব এর আগে শরীফের গ্যারেজে কাজ করতো। কিন্তু সে সেখান থেকে কাজ ছেড়ে দিয়ে নগরীর পিটিআই মোড়ে নাসিরের গ্যারেজে কাজ নেয়। এ ঘটনায় ক্ষুব্ধ হয়ে শরীফ ও তার ভাই মিন্টু পরিকল্পিতভাবে তাকে শায়েস্তা করতে এ পথ বেছে নেয়।
খুলনা সদর থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) সুকুমার বিশ্বাস জানান, কিশোর রাকিবকে নগরীর টুটপাড়া কবরখানা সংলগ্ন শরীফের মোটরসাইকেল গ্যারেজে নিয়ে মোটরসাইকেলের টায়ারে হাওয়া দেওয়া মেশিন মলদ্বারে ঢুকিয়ে পেটে হাওয়া দেয় শরীফ ও মিন্টু। এক পর্যায়ে শিশু রাকিব পেটসহ শরীরের বিভিন্ন অংশ ফুলে-ফেঁপে ওঠে। এ সময় গুরুতর অসুস্থ হয়ে পড়ে রাকিব। এ সময় নির্যাতনকারীরা রাকিবের শরীরের বিভিন্ন অংশে চাপ প্রয়োগ করে বাতাস বের করার চেষ্টা করে ব্যর্থ হয়। উপায়ন্তর না দেখে রাকিবকে একটি প্রাইভেট ক্লিনিকে ভর্তি করা হয়। সেখানে অবস্থার অবনতি হলে তাকে খুলনা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। সেখানেও অবস্থার কোনো উন্নতি না হওয়ায় তাকে ঢাকায় নেওয়ার পথে সে মারা যায়।
এদিকে নির্যাতনকারী গ্যারেজ মালিক শরীফ, তার মা বিউটি বেগম (৫৫) ও সহযোগী মিন্টুকে স্থানীয় জনগণ গণধোলাই দিয়ে রাতে পুলিশে সোপর্দ করে। তাদের দুজনকে খুলনা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের প্রিজন সেলে রেখে চিকিৎসা দেওয়া হচ্ছে।
পুলিশ জানায়, শিশু রাকিবকে নির্যাতনের সময়ে বিউটি বেগম পাশে থাকলেও তাকে রক্ষা করার চেষ্টা করেনি।
খুলনা সদর থানার ওসি সুকুমার বিশ্বাস জানান, নিহত রাকিবের বাবা নুরুল আলম মঙ্গলবার সকালে একটি হত্যা মামলা দায়ের করেছেন।
মামলার তিন আসামি হলেন গ্যারেজ মালিক মিন্টু মিয়া (৪০), কর্মচারী শরীফ (৩৫) এবং শরীফের মা বিউটি বেগম (৫৫)।
মঙ্গলবার রাকিবের ময়নাতদন্ত সম্পন্ন হয়েছে। পরে তার লাশ নিয়ে এলাকাবাসী হত্যাকারীদের গ্রেপ্তার ও শাস্তির দাবিতে নগরীতে বিক্ষোভ মিছিল করে।
এদিকে শিশু রাকিবকে নির্মমভাবে হত্যার ঘটনায় গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করে বিবৃতি দিয়েছেন বাংলাদেশ হিউম্যান রাইটস ফাউন্ডেশনের চেয়ারপারসন এ্যাড. এলিনা খান, খুলনা মহানগর শাখার সভাপতি মো. খলিকুজ্জামান, জেলা শাখার সভাপতি এ্যাড. স ম বাবর আলী, মহানগর শাখার সাধারণ সম্পাদক এ্যাড. ফরিদ আহমেদ, জেলা শাখার সাধারণ সম্পাদক সাংবাদিক মিজানুর রহমান মিলটন, এ্যাড. সাহারা ইরানী পিয়া, গোলাম কিবরিয়া তুহিন প্রমুখ। বিবৃতিতে নেতৃবৃন্দ দ্রুত সময়ের মধ্যে দোষীদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির দাবি জানিয়েছেন।
অপর দিকে শিশু রাকিবের পেটের ভিতর বাতাস ঢুকিয়ে নির্মম ও নিষ্ঠুরভাবে হত্যার তীব্র নিন্দা-প্রতিবাদ ও হত্যাকারীদের কঠিন এবং কঠোর শাস্তির দাবি করেছেন খুলনা মহানগর বিএনপির নেতৃবৃন্দ।
এই নির্মম ঘটনার প্রতিবাদ জানিয়ে বিবৃতি দিয়েছেন, বেসরকারি সংগঠন জনউদ্যোগ, খুলনার আহবায়ক এ্যাড. কুদরত-ই-খুদা ও সদস্য সচিব মহেন্দ্র নাথ সেন।
এ ঘটনার প্রতিবাদে বুধবার জনউদ্যোগ ও বাংলাদেশ মানবাধিকার বাস্তবায়ন সংস্থার উদ্যোগে বেলা ১১টায় পিকচার প্যালেস মোড়ে শিশু রাকিব হত্যার বিচারের দাবিতে মানববন্ধন অনুষ্ঠিত হবে।