গারো পাহাড়ের কষ্টগাথা: জালিয়াতি, বুনোহাতি আর কর্মহীনতায় কোণঠাসা আদিবাসীরা

এম. সুরুজ্জামান, শেরপুর: শেরপুরের সীমান্তবর্তী গারো পাহাড়ের আদিবাসীদের দিন ভালো কাটছে না। তাদের খোঁজ-খবর নেওয়ার কেউ নেই। তাদের কেন্দ্র করে সরকারের উন্নয়ন উদ্যোগ নেই বললেই চলে। তাই আদিবাসীদের জীবন বদলায় না। এ নিয়ে শেরপুরের নালিতাবাড়ী উপজেলার খলচান্দা গ্রামের সত্তর বছর বয়সী আদিবাসী মন্ডল শবরন্ত কোচের আক্ষেপের অন্ত নেই। শবরন্ত বললেন, অভাব-অনটন, দুঃখ-দুর্দশাই আদিবাসীদের নিত্যদিনের সাথী, ভালো নেই এখানকার আদিবাসীরা। বছর ঘুরে আন্তর্জাতিক আদিবাসী দিবস আসলেও তারা জানে না এই দিবসের তাৎপর্য।

ভারতের মেঘালয় রাজ্যের সীমান্ত ঘেঁষে শেরপুরের গারো পাহাড়। জেলার ঝিনাইগাতী, শ্রীবরদী ও নালিতাবাড়ী উপজেলায় গারো, হাজং, কোচ, বানাই, ডালু, হদি, বর্মন ও বংশীসহ বিভিন্ন জাতি-গোত্র, নৃ-তাত্ত্বিক জনগোষ্ঠী মিলে ১০ হাজারের বেশি আদিবাসী পরিবারের বসবাস। এদের ৭০ শতাংশ পরিবার দারিদ্রসীমার নিচে বাস করে।

একসময় পাহাড়ি আদিবাসীদের বেশ সম্পন্ন ছিল। কিন্তু আস্তে আস্তে অনেক প্রতিকূলতার মধ্যে পড়ে তারা। জীবনধারণের মূল উপকরণ জমিজমা হাতছাড়া হতে থাকে তাদের। জাল-জালিয়াতি আর পেশিশক্তির জোরে জমি গ্রাস করেছে স্থানীয় প্রভাবশালীরা। এখন তারা একপ্রকার ভূমিহীন। বন বিভাগের জমিতে ছোট ছোট ঘর বানিয়ে মাথা গোঁজার ঠাঁই করে নিয়েছে। মজুরি খাটাসহ নানাভাবে জীবিকা নির্বাহ করছে তারা। আদিবাসীদের একটি অংশ স্বচ্ছল। জমাজমিও আছে। তবে বাধ সেধেছে বুনোহাতির উপদ্রব। হাতির তান্ডবে প্রায় একযুগ জমির ফসল ঘরে আসছে না।

বিভিন্ন সূত্রে জানা গেছে, সহজ-সরল আদিবাসীদের জীবনযাপনও খুব সাদাসিধে। এ সুযোগটাকেই কাজে লাগিয়েছে জালিয়াতচক্র। ছলচাতুরি করে তাদের জমি কেড়ে নিয়েছে।

indigenous people of sherpur
কাঠ কুড়িয়ে ঘরে ফিরছেন এক আদিবাসী নারী।

ঝিনাইগাতীর বাকাকুড়া গ্রামের আদিবাসী রঘুনাথ কোচের ২ একর জমি স্থানীয় সন্ত্রাসীদের দখলে। নওকুচি গ্রামের পাজাই কোচনীদের জমির দখলও চলে গেছে  প্রভাবশালীদের হাতে। আদিবাসীদের নারীরা ক্ষেতে খামারে, মাঠে-ময়দানে, সংসারের সকল কাজে ব্যস্ত থাকেন। পুরুষরা একসময় ছেলে-মেয়েদের দেখাশুনার দায়িত্ব পালন করলেও এখন বেঁচে থাকার তাগিদেই সব কাজ করছেন।

আমন ও বোরো মৌসুমে আদিবাসী নারী-পুরুষরা ক্ষেতে কাজ করে। এটাই তাদের প্রধান রোজগারের সময়।  বছরের বাকি ১০ মাস তাদের থাকতে হয় বেকার, নির্ভর করতে হয় বনের ওপর।  নারীরা পাহাড় থেকে জ্বালানি কাঠ সংগ্রহ করে বাজারে বিক্রি করেন। কিন্তু গারো পাহাড়ে এখন আর আগের মতো জ্বালানি কাঠ মেলে না। যেটুকু পাওয়া যায় সেটুকুও আনতে দেয় না বন বিভাগের কর্মকর্তা, কর্মচারী ও শরিকরা। আদিবাসী শ্রমিকদের জন্য কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা গড়ে ওঠেনি। ফলে শেরপুরের তিন উপজেলার আদিবাসীরা নিরন্তর দুঃখ-কষ্টের মধ্যে আছে। অনেক আদিবাসী বাড়ি গুঁড়িয়ে দিয়েছে হাতির দল। আদিবাসীরা প্রতিনিয়ত বুনোহাতির সাথে যুদ্ধ করে টিকে আছে।

ঝিনাইগাতীর গজনী গ্রামের মনেন্দ্র কোচ, হালচাটী গ্রামের সুরেন্দ্র কোচ, রাংটিয়া গ্রামের বীর মুক্তিযোদ্ধা মজেন্দ্র চন্দ্র কোচ, নালিতাবাড়ী উপজেলার পরিমল কোচ জানান, পেটে খাবার না থাকলেও প্রতিরাতে হাতি তাড়ানোর জন্য কমপক্ষে দুই লিটার কেরোসিন কিনতে হয় তাদের। প্রথম দিকে সরকারিভাবে এবং বিভিন্ন জনপ্রতিনিধির মাধ্যমে হাতি তাড়ানোর জন্য কেরোসিন বিতরণ করা হলেও এখন তা বন্ধ। এখন আর কেউ খোঁজখবর নেয় না। সরকারিভাবে কয়েকটি জেনারেটর দেওয়া হয়েছিল হাতি তাড়ানোর জন্য। এসব জেনারেটর আর চোখে পড়ে না। এক সময় পাহাড়ি জনপদের আদিবাসীরা পাহাড়ে জুম চাষ করে জীবিকা নির্বাহ করত। কিন্তু পাহাড় উজাড় ও বুনোহাতির তাণ্ডবে আদিবাসীদের জুম চাষ হারিয়ে গেছে। শিক্ষায়ও কোচ আদিবাসীরা অনেক পিছিয়ে। আর নানাদিক থেকে অবহেলিত ও পিছিয়ে রয়েছে কোচ সম্প্রদায়ের লোকজন। এখানের আদিবাসীরা তুলনামূলকভাবে ভিজিডি, ভিজিএফ, বয়স্ক, বিধবা ও প্রতিবন্ধী ভাতা ইত্যাদি সুবিধাও কম পায়।

তথ্যানুসন্ধানে আরো জানা গেছে, সহায়-সম্বলহীন এসব আদিবাসীদের খাবার আর পরনের কাপড়ের সংস্থান করা খুবই কষ্টকর। পাহাড়ি আলু খেয়ে আর দিনমজুরি করে খেয়ে-না-খেয়ে মানবেতর জীবন যাপন করছে তারা। আদিবাসীদের উন্নয়নের জন্য এনজিও বিভিন্ন কাজ করে আসলেও তা চাহিদার তুলনায় খুব কম। বর্তমানে জীবিকার তাগিদে গারো আদিবাসী নারী-পুরুষরা দেশের বিভিন্ন স্থানে কর্মক্ষেত্র তৈরি করে নিচ্ছে। বিশেষ করে রাজধানী ঢাকাসহ দেশের বিভাগীয় শহরগুলোতে গারো মেয়েরা বিউটি পার্লারে কাজ করছে।

গারো আদিবাসী নেতা প্রদীপ জেংচাম বলেন, আদিবাসী শিক্ষার্থীরা অনেক পিছিয়ে আছে। এদের সরকারিভাবে কম্পিউটার প্রশিক্ষণ গ্রহনের সুযোগ দেয়া হয় না। ফলে তথ্য-প্রযুক্তির দিক দিয়ে আদিবাসীরা অনেক পিছিয়ে রয়েছে।

আদিবাসী নেতা ও পোড়াগাঁও ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সভানেত্রী বন্দনা চাম্বুগং বলেন, সরকারি চাকুরির ক্ষেত্রে আদিবাসীদের নেয়া হয় না। সম্প্রতি পুলিশে লোক নিয়োগ দেওয়া হয়েছে। কিন্তু শেরপুর জেলার কোনো গারো আদিবাসীকে এই চাকুরিতে নিয়োগ দেওয়া হয়নি।

এ ব্যাপারে শেরপুরের নালিতাবাড়ী উপজেলার আদিবাসী সংগঠন ট্রাইবাল ওয়েলফেয়ার এ্যাসোসিয়েশনের (টিডব্লিউএ) চেয়ারম্যান লুইস নেংমিনজা বলেন, শেরপুর জেলার আদিবাসীরা অনাদিকাল থেকে বুনোহাতির অত্যাচার ও দারিদ্রের সাথে লড়াই করে বনে-জঙ্গলে বসবাস করছে। অবহেলিত এসব আদিবাসীদের প্রতি সরকারের বিশেষ নজর দেওয়া প্রয়োজন।