প্রতিনিধি, বাগেরহাট: একাত্তরের মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলায় বাগেরহাটের রাজাকার শেখ সিরাজুল হক ওরফে কসাই সিরাজের ফাঁসি এবং খান আকরাম হোসেনের আমৃত্যু কারাদণ্ডের রায়ে মুক্তিযোদ্ধাসহ বাগেরহাটের সর্বস্তরের মানুষ সন্তোষ প্রকাশ করে দ্রুত রায় কার্যকরের দাবি জানিয়েছেন।
মঙ্গলবার দুপুরে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-১ রায় ঘোষণার পর বাগেরহাটের গোটাপাড়া, শাঁখারিকাঠী, রঞ্জিতপুর, ডাকরা, বেসরগাতী, কান্দাপাড়া, টেংরাখালী, তেলিগাতী, চুলকাঠি, ঘনশ্যামপুর-সহ বিভিন্ন স্থানে মুক্তিযোদ্ধাসহ সর্বস্তরের মানুষ মিছিল করেছেন।
মঙ্গলবার সকাল থেকেই কসাই সিরাজ ও অকরাম হোসেনের ফাঁসির রায় শোনার অপেক্ষায় ছিলো গোটা বাগেহরাটবাসী। মুক্তিযোদ্ধাসহ সাধারণ মানুষ রায়ের খবর শোনার জন্য টেলিভিশনসহ অনান্য গনমাধ্যমে চোখ রাখছিলেন। রাজাকার কসাই সিরাজের ফাঁসির এবং খান আকরাম হোসেনের আমৃত্যু কারাদণ্ডের রায় শোনার পর উল্লাসে ফেটে পড়েন মুক্তিযোদ্ধাসহ সর্বস্তরের সাধারণ মানুষ। তাৎক্ষণিক আনন্দ মিছিল বের করেন তারা।
আনন্দ মিছিল বের হয় কসাই সিরাজের নিজ এলাকা মুক্ষাইট বাজারে। এসময় স্থানীয়রা মিষ্টি বিতরণ করেন। এ আনন্দ মিছিলে কসাই সিরাজের নিকট আত্মীয়রাও স্বতঃস্ফূর্তভাবে অংশ নেন। মুক্তিযুদ্ধের সময় কসাই সিরাজ তার একাধিক নিকট আত্মীয়কেও অকারণে প্রকাশ্যে হত্যা করেন।
রায়ের পর বাগেরহাট জেলা মুক্তিযোদ্ধা সংসদের উদ্যোগে শহরে একটি বিশাল আনন্দ মিছিল বের করা হয়। মিছিলে বাগেরহাট জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি ও সংসদ সদস্য ডা. মোজাম্মেল হোসেন ও জেলা আওয়ামী লীগের সিনিয়র সহ-সভাপতি বাগহেরহাট সংসদ সদস্য এ্যাডভোকেট মীর শওকাত আলী বাদশাসহ বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষ অংশ নেন। প্রধান প্রধান সড়ক প্রদক্ষিণ শেষে মিছিলটি পুরাতন কোর্টচত্বরে সংসদ কার্যালয়ে এসে শেষ হয়। এসময় মিষ্টি বিতরণ করা হয়। তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়ায় মুক্তিযোদ্ধারা দ্রুত এ রায় কার্যকর করার দাবি জানান।
বাদী ও স্বাক্ষীর প্রতিক্রিয়া
রায় ঘোষণার পর আনুষ্ঠানিক প্রতিক্রিয়ায় মামলার বাদী শহীদ জিতেন্দ্রনাথ দাসের ছেলে মুক্তিযোদ্ধা নিমাইচন্দ্র দাস ও বাগেরহাট মুক্তিযোদ্ধা সংসদ কমান্ডের সহকারী কমান্ডার মামলার স্বাক্ষী মোস্তাফিজুর রহমান বাদশা এই প্রতিবেদকে বলেন, কসাই সিরাজের ফঁসির আদেশে আমরা খুশি। কিন্তু আকরাম হোসেনেরও ফাঁসি প্রত্যাশা করেছিলাম আমরা।
রাজাকার সিরাজুল হক ওরফে কসাই সিরাজের বাড়ি সদর উপজেলার গোটাপাড়া গ্রামে। সেখানে যুদ্ধের পর থেকে সে আর ফিরে যায়নি। তবে তার চাচি নুরজাহান বেগম বলেন, “সে আমাকেও হত্যা করতে চেয়েছিল। বাড়ি-ঘর পুড়িয়ে দিয়েছে। ওর হাত থেকে বাঁচতে আমিও লুকিয়ে ছিলাম।”
বাগেরহাট জেলা বিএনপির প্রাক্তন সভাপতি এ্যাডভোকেট জাহাঙ্গীর আলী বাবু রায় ঘোষণার পর তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়ার সন্তোষ প্রকাশ করে বলেন, ওই নরঘাতক সিরাজ আমার চাচাতো ভাই ওহাবকেও নির্মম ভাবে হত্যা করেছে। ওহাব বাগেরহাট শহরের হরিনখানার মৃত সুলতান আলীর ছেলে ছিলেন। তিনি আরো বলেন, প্রতিদিন সকালে মানুষ হত্যা না করে যে নাস্তা করত না, সেই কুখ্যাত নরঘাতক বাগেরহাটের জল্লাদ খ্যাত সিরাজ মাস্টার ওরফে জল্লাদ সিরাজের অবশেষে ফাঁসির আদেশ হয়েছে, এটা খুবই স্বস্তির খবর।
গোটাপাড়া গ্রামের একরাম হোসেন, সামাদ খান, নাহিদ হোসেন, ইয়াকুব আলীসহ অনেকে জানান, একাত্তরে রাজাকার সিরাজের নির্যাতনে তারা কেউ ভাই, কেউ বাবা, চাচা, দাদা হারিয়েছেন। তাদের নির্যাতনের হাত থেকে শিশু থেকে বৃদ্ধ কেউই রক্ষা পায়নি। এলাকার মুক্তিযোদ্ধা নুর মোহাম্মদ জানান, কসাই সিরাজ এই এলাকায় মানুষের উপর সে নির্মম নির্যাতন ও হত্যাযজ্ঞ চালিয়েছে তার ফাঁসির আদেশও কম বলে মনে হয়।
নিজের ছাত্র ও নিকট আত্মীয়সহ সহস্ত্রাধিক মানুষকে জবাই ও গুলি করে নৃশংস হত্যা করে জল্লাদ সিরাজ। মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে কচুয়ার শাখারীকাঠি বাজারে গণহত্যা, ধর্ষণ ও বাড়িতে অগ্নিসংযোসহ ছয়টি সুনির্দিষ্ট অপরাধে ৮১৯ জনকে হত্যার অভিযোগে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে মানবতাবিরোধী মামলার পলাতক প্রধান আসামি বাগেরহাটে রাজাকার কমান্ডার সিরাজুল হক ওরফে সিরাজ মাস্টার ওরফে জল্লাদ সিরাজকে (৭৪) সদরের ডেমা গ্রাম থেকে পুলিশ ২০১৪ সালের ২০ জুলাই রাতে আটক করে।
মুক্তিযুদ্ধের সময় কচুয়ার শাখারীকাঠি বাজারে গণহত্যার ঘটনায় রঘুদত্তকাঠি গ্রামের শহীদ জিতেন্দ্রনাথ দাসের ছেলে মুক্তিযোদ্ধা নিমাইচন্দ্র দাস বাদী হয়ে ২০০৯ সালে কচুয়া থানায় কুখ্যাত এই রাজাকার কমান্ডারসহ ১২ জনকে আসামি করে মামলা দায়ের করেন।