প্রতিনিধি, বাগেরহাট: সজলকে সবাই জানত পুরুষ হিসেবে। চুল ছোট ছোট করে ছাঁট দেওয়া। প্যান্ট-শার্ট পরে। হাব-ভাব চটপটে কিশোরদের মতো।
এরকম বেশভূষা সে শখের বসে নেয়নি। অভাব-অনটনের কারণেই তার এই বদলে যাওয়া। নিরাপত্তার জন্য তাকে ছেলে সাজতে হয়েছে। ছেলে সেজে ভ্যান চালাত সে। শৈশবে বাবাকে হারানো নাইমা শুধু খেয়ে-পরে বেঁচে থাকার তাগিদেই হয়ে গেল সজল। ভ্যান চালিয়ে মোটামুটি চালিয়ে নিচ্ছিল সে।
কিন্তু একদল সত্যিকারের পুরুষ অথবা কাপুরুষ আবিষ্কার করে সজল পুরুষ নয়। সে নারী। সে কিশোরী। আর সেই পুরুষদের একজন আদিম প্রবৃত্তি নিয়ে ক্ষুধার্ত বাঘের মতো পিছু নেয় সজলরূপী নাইমার। এবং শেষ পর্যন্ত সর্বনাশটা করেই বসে সে। নাইমা ধর্ষণের শিকার হয়। নাইমা কুমারিত্ব হারায়। তার গর্ভে ধীরে ধীরে বেড়ে উঠে আরেক মানুষ। আরেক নারী।
মঙ্গলবার বাগেরহাটের শরণখোলা উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে এক ফুটফুটে কন্যা সন্তানের জন্ম দেয় নাইমা। কুমারী মা হওয়ার যাবতীয় অস্বস্তি নিয়ে লোকলজ্জার ভয়ে জড়োসড়ো হয়ে যাওয়ার কথা তার। কিন্তু উল্টোটাই করছে সে। অজ্ঞাত পিতার এ সন্তানের জন্য হয়তো কোনো দায় নেই। কিন্তু নাইমা দায়িত্ব এড়াচ্ছে না। প্রবল স্নেহে সারাক্ষণ আগলে রাখছে নবজাত শিশুটিকে।
সাংবাদিকদের কাছেও সন্তানকে নিজের কাছে রাখার আর্তি জানায় নাইমা। একটা ‘ছেলে’ রিকশাওয়ালার সন্তান হয়েছে। পুরো এলাকায় এ নিয়ে নানারকম গুঞ্জন, নানা আলাপ-বিলাপ, অকারণ চাঞ্চল্য। লোকলজ্জা ডিঙ্গিয়ে নাইমার পরিবারের কেউ তাকে দেখতে হাসপাতালে আসার সাহস করেনি। হাসপাতালের বিছানায় একাই সন্তানটির দেখভাল করছে এই ১৫ বছরের কিশোরী। মাতৃত্বের জন্য তার আয়-রোজগার বন্ধ। খাবারেরও কোনো যোগান নেই। হাসপাতালের সামান্য খাবার খেয়ে বেঁচে থাকছে সে, বাঁচিয়ে রাখছে সদ্যজাত কন্যাটিকে।
খোন্তাকাটা ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান খান মতিয়ার রহমান জানতেন সজলের কথা। জানালেন, বছর দেড়েক আগে কয়েকজন মিলে সজলকে প্যান্ট-শার্ট পরা অবস্থায় তার কাছে নিয়ে আসে। তাদের অভিযোগ, মেয়ে হয়েও নাইমা ছেলের মতো চলে। নাইমা চেয়ারম্যানকে তার অসহায়ত্বের কথা জানায়। দারিদ্র্যের কারণেই তার এই বদলে যাওয়া। বিষয়টি জানার পর চেয়ারম্যান নাইমার ওপর কাউকে হস্থক্ষেপ না করতে বলে দেন। চেয়ারম্যান জানালেন, দীর্ঘদিন ধরে সার্বক্ষণিক পুরুষ ছদ্মবেশের কারণে এলাকার বেশিভাগ মানুষ তাকে ছেলে বলেই জানতো। তার জীবনে যা ঘটেছে তা খুবই দুঃখজনক।
শরণখোলা প্রেসক্লাবের সভাপতি ইসমাইল হোসেন লিটন বলেন, নাইমার সন্তান জন্মানোর খবর পেয়ে হাসপাতালে গিয়ে তার বর্ণনা শুনে মনে হয়েছে, সামাজিক ও মানবিকতার এক চরম অবক্ষয় ঘটেছে। অভাব, দরিদ্রতার মধ্যে সামাজিক নিরাপত্তার জন্য পুরুষের ছদ্মবেশে থাকতো নাইমা। কিন্তু তাতেও লম্পটদের লালসার হাত থেকে রেহাই পায়নি সে।
কান্নাজড়িত কন্ঠে সাংবাদিকদের কাছে নিজের নিরাপত্তা দাবি জানিয়েছে নাইমা। স্বাভাবিক জীবন যাপনের জন্য ব্যক্তি বা সংগঠনের সহায়তাও চেয়েছে সে।
শরণখোলা উপজেলা স্বাস্থ্য কর্মকর্তা ডা. অসীম কুমার সমাদ্দার জানান, নাইমা ও তার সন্তান সুস্থ রয়েছে। হাসপাতালে তার সুচিকিৎসাসহ প্রয়োজনীয় সহায়তা করা হয়েছে।
নাইমা অবশ্য একটা নিরাপত্তা পেয়েছে পুলিশের তরফ থেকে। শরণখোলা থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) রেজাউল করিম জানান, কেউ যেন নাইমার ওপর প্রভাব বিস্তার করতে না পারে এ জন্য তাকে সার্বিক নিরাপত্তা দেয়া হচ্ছে। তার নিরাপত্তার জন্য হাসপাতালে সার্বক্ষণিক একজন নারী পুলিশ কনেস্টবেলসহ দুজন পুলিশ সদস্য নিয়োজিত রয়েছেন।
এই নিরাপত্তাটা হয়তো সাময়িক। বাইরের সমাজটা আরো বড়। আরো জটিল। সেই সমাজ নাইমা আর তার সন্তানকে কেমন করে স্বাগত জানাবে তার উত্তর জানা নেই কারো।
[ভুক্তভোগীর আসল নাম ব্যবহার করা হয়নি। তার দেয়া তথ্য অনুযায়ী রায়েন্দা বাজারের হার্ডওয়্যার ব্যবসায়ী রফিকুল ইসলাম তালুকদারকে ধর্ষণের অভিযোগে গ্রেফতার করেছে পুলিশ। থানায় মামলা হয়েছে।]