ইউএনও আতঙ্কে বটিয়াঘাটা সাংবাদিকশূন্য

একজন শিক্ষককে অহেতুক লাঞ্ছিত করার পর প্রতিবাদী মানুষদের মানববন্ধনের সংবাদ প্রকাশ করায় খুলনার বটিয়াঘাটা উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা সাংবাদিকদের মামলায় জড়িয়ে জেল-জরিমানা করে হয়রানি করে যাচ্ছেন। এই কর্মকর্তার ভয়ে এখন বটিয়াঘাটার সাংবাদিকরা পালিয়ে বেড়াচ্ছেন। শুধু সাংবাদিক নয়- শিক্ষক, জনপ্রতিনিধি, সাধারণ মানুষ কেউ নিস্তার পাচ্ছেন না তার ‘আইনি মারপ্যাঁচ’ থেকে।

প্রতিনিধি, খুলনা: মানববন্ধনের সংবাদ পরিবেশন করায় চার সাংবাদিককে মামলায় জড়ানো ও জেল-জরিমানা করা হয়েছে। বাকিদের ভ্রাম্যমাণ আদালতের আওতায় এনে বিচার ও হয়রানি করতে উদ্দেশ্যমূলকভাবে নোটিশ দিচ্ছেন বটিয়াঘাটার উপজেলা নির্বাহী অফিসার (ইউএনও)। ইউএনওর হাতে লাঞ্ছিত হয়েছেন মুক্তিযোদ্ধা, শিক্ষক, সাংবাদিক, জনপ্রতিনিধি ও সাধারণ মানুষ। ভয় আর আতঙ্কে বটিয়াঘাটা উপজেলা এখন সাংবাদিকশূন্য। তালা ঝুলছে উপজেলার দুটি প্রেসক্লাবে।

মত প্রকাশের স্বাধীনতায় অন্তরায় হয়ে দাঁড়িয়েছেন এখানকার উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মো. বিল্লাল হোসেন খান। তার ভয়ে শুধু সাংবাদিকই নয়, গোটা উপজেলার মানুষ আতঙ্কিত।

গত ১৬ জুলাই একজন কলেজ শিক্ষককে লাঞ্ছিত করার প্রতিবাদে অনুষ্ঠিত ২০ জুলাই মানববন্ধনের সংবাদ পরিবেশন করায় সাংবাদিকদের ওপর এ হয়রানি শুরু হয়েছে বলে উপজেলার একাধিক বিশিষ্টজন ও সাংবাদিকরা জানান।

ঘটনার সূত্রপাত ১৬ জুলাই, ২৮ রমজান। অনুপ কুমার মন্ডল কলেজে শিক্ষকতা করেন। পাইকগাছা উপজেলার কালিনগর কলেজের প্রভাষক। অনুপ কুমার মন্ডল জানান, তিনি বটিয়াঘাটা উপজেলার বাসস্ট্যান্ড মোড়ে পর্দা দেয়া একটি চায়ের দোকানে রুটি খাচ্ছিলেন। এমন সময় উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মো. বিল্লাল হোসেন খান সেখানে এসে অনুপকে বলেন, “আপনি জানেন না এটা রমজান মাস। আপনি প্রকাশ্যে খাচ্ছেন কেন?” এর উত্তরে প্রভাষক অনুপ বলেন, “প্রকাশ্যে নয়, পর্দাবেষ্টিত দোকানে খাচ্ছি। আর আমি একজন হিন্দু মানুষ; আমার তো রোজা রাখার বিধান নেই।” একথা বলতেই ইউএনও প্রভাষক অনুপকে শার্টের কলার ধরে হোটেলের বাইরে এনে চড় মেরে বলেন, “এই তুই আমাকে চিনিস, আমি কে? আমি তোকে তিন মাসের জেল দিতে পারি।” এই বলেই ইউএনও অনুপকে গাড়িতে উঠাতে পুলিশকে নির্দেশ দেন বলে অনুপ জানান। এ সময় এলাকার লোকজন এসে ইউএনওকে অনুরোধ করলে অনুপকে ছেড়ে দেন তিনি।

এ ঘটনার খবর এলাকায় ছড়িয়ে পড়লে সাধারণ মানুষের মধ্যে তীব্র ক্ষোভের সৃষ্টি হয়। একাধিক সূত্র জানায়, ঈদের পর ২০ জুলাই উপজেলা সদরে সর্বসাধারণের উদ্যোগে শিক্ষককে লাঞ্ছিত করার প্রতিবাদে বিশাল মানববন্ধন অনুষ্ঠিত হয়। যে সকল মানুষ মানববন্ধনে অংশগ্রহণ করেছে এবং যে সকল সাংবাদিক মানববন্ধনের সংবাদ পরিবেশন করেছেন তাদের নামের তালিকা করে একে একে ভ্রাম্যমাণ আদালতের নামে একেকজনকে অর্থদণ্ডসহ বিভিন্ন মেয়াদে সাজা প্রদান করছেন ইউএনও বিল্লাল হোসেন খান।

স্থানীয় দৈনিক প্রবাহের সাংবাদিক আজিজুর রহমানের বিরুদ্ধে ইউএনওর নির্দেশে সহকারী কমিশনার (ভূমি) মিথ্যা মামলা করেছেন বলে অভিযোগ পাওয়া গেছে। দৈনিক সংবাদের বটিয়াঘাটা প্রতিনিধি মুক্তিযোদ্ধা অধ্যাপক এনায়েত আলী বিশ্বাস মানববন্ধনের সংবাদ করেছেন। ২৩ জুলাই উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তার অফিসে গেলে ইউএনও অধ্যাপক এনায়েত আলী বিশ্বাসকে ‘বাস্টার্ড’ বলে গালি দিয়ে বলেন, “আমার বিরুদ্ধে সংবাদে নিউজ করেছেন কেন? আমি দেখে নিবো।” এ ঘটনার পরে ২৬ জুলাই এনায়েত আলীর বাসার সামনে ব্যক্তিগত একটি ইজিবাইক রাখার ‘অপরাধে’ ১৫ হাজার টাকা জরিমানা অনাদায়ে তিন মাসের জেলের নির্দেশ দেন। উপস্থিতভাবে টাকা দিতে না পারায় অধ্যাপক এনায়েত আলীকে হ্যান্ডকাপ পরিয়ে থানায় নেয়া হয়। পরে টাকা পরিশোধ করে তাকে মুক্ত করা হয়। পরবর্তীতে ২৮ জুলাই পুনরায় ইউএনও এনায়েত আলীকে সংবাদ পরিবেশনের ডকুমেন্ট চেয়ে কারণ দর্শানো নোটিশ প্রদান করেন। নোটিশ পেয়ে এনায়েত আলী ভয়ে ও আতঙ্কে উপজেলা ছেড়েছেন বলে জানা গেছে।

এদিকে দৈনিক আমাদের সময়ের সাংবাদিক ও ইউনিয়ন পরিষদের মেম্বার বিবেক বিশ্বাস জানান, ওই মানববন্ধনে অংশগ্রহণ করায় তাকে উপজেলা পরিষদে পেয়ে ইউএনও বলেন, “আমার বিরুদ্ধে মানববন্ধন করেন? আপনার গাড়ি আছে। গাড়ির কাগজ আছে?” এ সময় বিবেক বলেন, আমি গাড়ি চালাই না, কাগজ নেই বলে গাড়ি বাড়িতে রেখে দিয়েছি। স্যার আমার ভুল হয়েছে, এ পর্যায়ে আমাকে ক্ষমা করে দিন”। তখন ইউএনও বলেন, “এই আমার বিরুদ্ধে মানববন্ধন করেছিলেন সে সময়ে আমাকে ক্ষমা করেছিলেন যে, এখন আপনাকে ক্ষমা করবো? কোনো ক্ষমা হবে না”। এ বলে বিবেককে কাগজ না থাকার অজুহাতে ৪ হাজার ৭০০ টাকা জরিমানা করেন। এখানেই ক্ষান্ত হননি ইউএনও। পরবর্তীতে ইউপি মেম্বারের পদ থেকে বরখাস্ত করার জন্য চেয়ারম্যানের কাছে চিঠি পাঠিয়েছেন বলে বিবেক জানান। ভয়ে শঙ্কিত বিবেক এখন এলাকায় এক প্রকার লুকিয়ে বেড়াচ্ছেন।

মানববন্ধন এবং ইউএনওর বিভিন্ন অনিয়ম নিয়ে সংবাদ করায় গত ১২ আগস্ট বাল্য বিবাহে সহযোগিতার অজুহাত দেখিয়ে দৈনিক নওয়াপাড়া পত্রিকার সাংবাদিক মো. শাহিন বিশ্বাসকে ১৩ মাসের জেল দিয়েছেন। এসময়ে ইউএনও বিল্লাল হোসেন খান শাহীনকে বলেন, “তুমি আমার বিরুদ্ধে মানববন্ধন এবং বিভিন্ন সংবাদ করো? এসব সংবাদ কোথায় বসে করো?” চাপে পড়ে শাহীন বলেন, “দৈনিক দেশ সংযোগের প্রতিনিধি রিংটন মন্ডলের অফিসে বসে সংবাদ করি।” ইউএনও রিংটন মন্ডলকে ডেকে আনার জন্য বলেন। পুলিশ রিংটনকে ফোন করলে রিংটন উপজেলা অফিসে আসেন। রিংটনের একজন শুভাকাঙ্খী  তাকে সরে যেতে বলেন। রিংটন ওই সময়ে আত্মগোপন করে বলে জানান তিনি। এখনো তিনি উপজেলার বাইরে পালিয়ে বেড়াচ্ছেন।

বটিয়াঘাটা প্রেসক্লবের সভাপতি শেখ আব্দুল হামিদ জানান, “মানববন্ধনের সংবাদ করায় তার বিরুদ্ধে বিভিন্ন লোক দিয়ে অভিযোগ সাজিয়ে বাড়িতে বার বার নোটিশ পাঠাচ্ছেন। এর আগে মুক্তিযোদ্ধা অধ্যাপক এনায়েত আলী, ইউপি মেম্বর বিবেক বিশ্বাস, সাংবাদিক শাহীন বিশ্বাসকে মিথ্যা অজুহাত দেখিয়ে অর্থদণ্ডসহ জেল-জরিমানা করেছেন বর্তমান ইউএনও বিল্লাল হোসেন খান। সর্বশেষ আমার বিরুদ্ধে মিথ্যা অভিযোগ সাজিয়ে বাড়িতে নোটিশ পাঠিয়েছেন।” মামলা, জেল-জরিমানার ভয়ে আব্দুল হামিদ এখন উপজেলাছাড়া। তার পরিবারের সদস্যরা ইউএনওর ভয়ে সব সময়ই আতঙ্কিত রয়েছেন।

অভিযোগ আছে, উপজেলা চেয়ারম্যানকে কৌশলে ভয় দেখানোর জন্য নিজের কোমর থেকে রিভলবার বের করে ইএনও বলেন, “দেখেন তো আমার হাতে কেমন এইম আছে, এই বলেই তিনি পাশের নারকেল গাছে গুলি ছোড়েন”। এভাবেই চলছে উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মো. বিল্লাল হোসেন খানের কর্মকাণ্ড।

এছাড়া উপজেলার সকল সাংবাদিক মামলা, জেল-জরিমানার ভয়ে উপজেলায় আসা বন্ধ করে দিয়েছেন। ফলে বটিয়াঘাটা উপজেলা এখন সাংবাদিক শূন্য হয়ে পড়েছে।

এ ব্যাপারে উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মো. বিল্লাল হোসেন খান জানান, একজন ইউএনও এতো গাধা নয় যে প্রমাণ ছাড়া শাস্তি দিবে। আমি কোনো সাংবাদিককে শাস্তি দেইনি। শাস্তি দিয়েছি চোর আর বদমাশদের। যারা অপরাধ করবে তাদের শাস্তি দিব, সে যেই হোক না কেন।