শ্রদ্ধা ভালোবাসায় চির বিদায় নিলেন গরিবের ডাক্তার

ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে সর্বস্তরের মানুষের শ্রদ্ধা আর ভালবাসায় টাঙ্গাইলের মধুপুর গড়াঞ্চলের কাইলাকুড়িতে নিজের প্রতিষ্ঠিত হাসপাতালের পাশে চিরনিদ্রায় শায়িত হলেন সকলের প্রিয় মানুষ ডা. এড্রিক বেকার। সকালে তার কফিনে ফুল দিয়ে শ্রদ্ধা জানান টাঙ্গাইলের জেলা প্রশাসক মো. মাহবুব হোসেন, মধুপুর উপজেলা পরিষদ চেয়ারম্যান সরোয়ার আলম খান আবু, উপজেলা নির্বাহী অফিসার মুক্তাদির আজিজসহ অন্যরা। তারপর একে একে কাইলাকুড়ি হাসপাতাল, মধুপুর জয়েনশাহী আদিবাসী উন্নয়ন পরিষদ, চিকিৎসক পরিষদসহ প্রায় অর্ধশত সংগঠন ফুল দিয়ে শ্রদ্ধা জানায়। দুপুর সোয়া ১২টায় খ্রীষ্টধর্মীয় রীতি অনুযায়ী তাকে হাসপাতালের পাশেই সমাহিত করা হয়।

তার দাফন অনুষ্ঠানে বৃহত্তর ময়মনসিংহের চিকিৎসকসহ বিভিন্ন ধর্ম, বর্ণ নির্বিশেষে হাজার হাজার মানুষ উপস্থিত হন। সবাই তাদের প্রিয় ‘বেকার ভাইকে’ চোখের জলে শেষ বিদায় জানান।

homage to dr. edric baker
ডা. বেকারের কফিনে ফুল দিয়ে শ্রদ্ধা জানান সর্বস্তরের মানুষ।

গরিবের ডাক্তার হিসেবে খ্যাত এই জনপ্রিয় চিকিৎসক মঙ্গলবার বেলা ২টার দিকে মধুপুর কাইলাকুড়ি হাসপাতালে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন।

ডা. বেকারের সঙ্গে কথোপকথন

একাত্তরের মহান মুক্তিযুদ্ধের সময় বাংলাদেশের মানুষের ওপর পাকিস্তানিদের হত্যা, বর্বরতা ও ভারতগামী শরণার্থীদের ছবি বিভিন্ন পত্রিকায় ছাপা হতো। পত্রিকায় বর্বরতার ছবি ও সংবাদ দেখেই মূলত বাংলাদেশি মানুষদের সেবা করার কথা ভাবেন নিউজিল্যান্ডের তখনকার তরুণ চিকিৎসক এড্রিক বেকার। মৃত্যুর দুই সপ্তাহ আগে এ প্রতিবেদকের সাথে তার হাসপাতালের আঙ্গিনায় বসে এসব কথা বলেন এড্রিক বেকার। ১৯৭১ সালে তিনি কাজ করছিলেন যুদ্ধবিধ্বস্ত ভিয়েতনামের একটি মেডিকেল টিমে। এরপর ১৯৭৯ সালে সত্যিই চলে আসেন বাংলাদেশে। সেই থেকে গত ৩৬ বছর যাবত তিনি বাংলাদেশে। মধুপুর গড় এলাকায় কাইলাকুড়িতে একটি হাসপাতাল প্রতিষ্ঠিত করে বৃহত্তর ময়মনসিংহের গরিব মানুষদের বিনামূল্যে চিকিৎসা দিতেন তিনি।

গত এক বছরের পরিসংখ্যানে দেখা গেছে, ডা. বেকার ২৭ হাজার রোগীকে স্বাস্থ্য বিষয়ে শিক্ষা দিয়েছেন। এ সময়ে ১৮ হাজার মা ও শিশুকে স্বাস্থ্য বিষয়ে শিক্ষা, শূন্য থেকে ৪ বছরের ১ হাজার ৬০০ শিশুর যত্নের ব্যবস্থা করা, ১ হাজার ১০০ গর্ভবতী মাকে সচেতন করার কাজ করেন তিনি ও তার দল। এক বছের তিনি ৪৭ হাজার রোগীকে আউটডোরে চিকিৎসা দেন, ৮০ জন যক্ষা রোগীকে সম্পূর্ণরূপে আরোগ্য করে তোলেন এবং ১৪০ জন রোগীর সার্জারি করেন। এক বছরে তার হাসপাতালে ১ হাজার ৭০০ রোগী ভর্তি হয়েছিল। এছাড়া ১ হাজার ৭০০ ডায়াবেটিস রোগী এখান থেকে চিকিৎসা নিয়েছে। তার হাসপাতাালে এমবিবিএস ডাক্তার ছাড়াও ২৫ জন প্যারামেডিক এবং প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত ৯৩ জন স্বাস্থ্যকর্মী কাজ করছেন।

বুধবার তার দাফন অনুষ্ঠানে উপস্থিত মধুপুর জয়েনশাহী আদিবাসী উন্নয়ন পরিষদের সভাপতি ইউজিন নকরেক এ প্রতিনিধিকে বলেন প্রত্যন্ত এলাকার মানুষেরা ডা. বেকারকে ‘‘বেকার ভাই” বলে ডাকতেন। তিনি শেষ দিন পর্যন্ত নিঃস্বার্থভাবে দরিদ্র মানুষের জন্য কাজ করে গেছেন। তার কোনো চাওয়া পাওয়া ছিল না।

এ প্রতিনিধির সাথে আলাপচারিতায় ডা. বেকার বলেছিলেন, হাসপাতালটা তো আমার না। এই হাসপাতালের পরিচালক হলেন গ্রামের গরিব-অসহায় সমাজকর্মী ও সমর্থকরা। তবে হ্যাঁ, তাদের দলনেতা আমি। তার মতে, এদেশের মানুষ খুব ভালো। তবে গ্রামের মানুষ আরো ভালো। অর্থের অভাবে যে সব দরিদ্র মানুষ চিকিৎসা সেবা পায় না তাদের সেবা করার জন্যই মুলত আমি  এদেশে এসেছি। আমি ব্যক্তিগত জীবনে অবিবাহিত। তবে দেশে আমার চার ভাই, দুই বোন ও বৃদ্ধা মা রায়েছে। আর বাবা ২০০৯ সালে মারা গেছেন। আমার পরিবারের সবাই আমার এ কাজকে মেনে নিয়েছেন। দেশে গেলে মা আমাকে জিজ্ঞাসা করেন, তুমি আবার কবে দেশে আসবে? দেশে গেলে বন্ধু-বান্ধব এবং বিভিন্ন সংস্থার লোকজনের কাছে আমার এই গরিবের হাসপাতালের কথা তুলে ধরি। তাদের দেয়া আর্থিক সাহায্যেই চলে গরিবের এই হাসপাতাল। আলাপচারিতায় ডা. বেকার তার ইচ্ছার কথা জানিয়ে বলেন, প্রতিবছর এদেশের কয়েক হাজার ছেলে-মেয়ে ডাক্তার হয়ে বের হচ্ছেন। আমি প্রতিক্ষায় আছি সেই দিনের অপেক্ষায় যেদিন এদের মধ্যে থেকে অন্তত একজন ডাক্তার চলে আসবেন আমাদের এই গরিবের হাসপাতালে। নিজেকে নিয়োজিত করবেন গ্রামের অসহায় দরিদ্র মানুষের চিকিৎসা সেবায়।

  • আবদুল্লাহ আবু এহসান