মিলন কর্মকার রাজু, কলাপাড়া (পটুয়াখালী): শুক্রবার বিকেল চারটা। কলাপাড়ার গাববাড়িয়া নদীতীরে কয়েক হাজার মানুষের ভীড়। সবার উৎসুক দৃষ্টি নদীর দিকে, কখন আকাশে উড়বে মাহবুবুর রহমান শাওনের তৈরি সি-প্লেনটি। সবার অপেক্ষার অবসান ঘটিয়ে উপস্থিত মানুষদের করতালির অভিনন্দনে সি-প্লেনটি নদীতে ভেসে চলা শুরু করলো। ২০ মিনিটের সফল পরীক্ষামূলক উড্ডয়ন শেষে তীরে ফিরে আসলো ১৮ বছরের শাওন তার আবিষ্কার নিয়ে।
একটি মোটরসাইকেলের ইঞ্জিন, ফ্যানের চারটি পাখা, এ্যালুমিনিয়াম রড, কাপড় ও পলিথিন দিয়ে তৈরি শাওনের সি-প্লেন। মাত্র ১৫ দিনের চেষ্টায় এ প্লেনটি তৈরি করে সে। লম্বায় সাড়ে ছয় ফুট ও প্রস্থে চার ফুট সি-প্লেনটি ৭০ থেকে ৮০ কেজি ওজন বহনে সক্ষম। মোটরসাইকেল ইঞ্জিন, তাই সেলফ স্টর্ট দিয়ে চালানো হয় প্লেনটি। প্লেনে বসার জন্য একটি চেয়ার স্থাপন করা হয়েছে। চালকের নিরাপত্তার জন্য মাথায় হেলমেট, লাইফ জ্যাকেট ও চালকের আসনের সামনে নিরাপত্তা গ্লাস বসানো হয়েছে। যে দুটি পাখায় ভর করে আকাশে উড়বে সেই পাখায় রয়েছে তিনটি স্তর। ফ্রেমে কাপড়, জাল ও পলিথিন দিয়ে শক্ত করে পাখা তৈরি। যাতে ছিড়ে না পড়ে।
পটুয়াখালীর কলাপাড়ার মোয়াজ্জেমপুর গ্রামের সালিয়া আলিম মাদ্রাসার শিক্ষক মো. নাসির উদ্দিনের দুই ছেলের মধ্যে বড় মাহবুবুর রহমান শাওন। কুয়াকাটা খানাবাদ কলেজ থেকে বিজ্ঞান বিভাগে এইচএসসি পাশ করে এখন বরিশাল আইডিয়াল কলেজে পড়ছে। কলেজ বন্ধ তাই বাসায় এসে অবসরে তৈরি করে ফেলেন এই সি-প্লেন।
শাওন জানায়, কলেজ ছুটির অবসরে মোবাইলে একদিন গুগলে সি-প্লেনের বিভিন্ন ছবি সার্চ দিয়ে ছবিগুলো দেখেন। ৬০/৭০ টি ছবি দেখার পর একটি ছবি তার পছন্দ হয়। ওইদিনই শাওন মনস্থির করে সি-প্লেন তৈরির। মোয়াজ্জেমপুর গ্রামের মেশিনারি যন্ত্রাংশ বিক্রেতা মো. জাকির হোসেনের কাছ থেকে একটি মোটরসাইকেলের ইঞ্জিন নিয়ে পরীক্ষা শুরু করেন। প্রথমে ডিজাইন তৈরি করে কাঠমিস্ত্রি মমিনের সহায়তায় প্লেনের কাঠের কাঠামো এবং মটরমিস্ত্রি জহির উদ্দিনের সহায়তায় এ্যালুমিনিয়ামের কাঠামো তৈরি করে প্লেন তৈরি শুরু করেন। এতে তার প্রায় ২০ হাজার টাকা খরচ হয়েছে।
শাওন বলেন, প্রায় ১৫ দিন পর নিজ বাড়ির পুকুরে প্রথমে চালু করে দেখেন প্লেনটি। এ খবর গোটা এলাকায় ছড়িয়ে পড়লে প্রতিদিন শতশত স্কুল-কলেজের ছাত্র-ছাত্রী ও এলাকাবাসী তার তৈরি প্লেনটি দেখতে বাসায় ভীড় করে। প্রথম পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হওয়ার পর তার সাহস বেড়ে যায়। তাই শুক্রবার হাজার হাজার মানুষের উপস্থিতিতে তিনি প্লেনটি উড়ান।
তিনি বলেন, এটা তার জীবনের প্রথম আবিষ্কার। কিন্তু সি-প্লেনটিতে একটু সমস্যা থাকায় তিনি বেশিক্ষণ এটা চালাননি। বর্তমানে মোটরসাইকেলের পুরনো ইঞ্জিন দিয়ে এটা তৈরি। আরো বেশি শক্তির ইঞ্জিন লাগালে উড়তে সমস্যা হবে না।
শাওনের ইচ্ছা বাংলাদেশে সরকারের কাছে তার এই প্রযুক্তি টি হস্তান্তর করা। পেট্রোল দিয়ে চলার কারণে এটা তৈরি ও চালানোর খরচও কম। তার এ প্রযুক্তি ব্যবহার হলে চরাঞ্চলে মানুষ যেখানে হাসপাতাল, ক্লিনিক কিংবা ডাক্তার নেই, সেই এলাকার মানুষ দ্রুত ও অল্প খরচে উপজেলা সদরে এসে ডাক্তার দেখাতে পারবে। এতে চরাঞ্চল ও নদীবেষ্টিত এলাকার মানুষ উপকৃত হবে।
শাওনের এ সি-প্লেনের উড়াল দেখতে বিভিন্ন স্কুল-কলেজের ছাত্র-ছাত্রী ছাড়াও বিভিন্ন বয়সের মানুষ উপস্থিত হন। পাড়াগাঁয়ের এক কলেজছাত্রের এ আবিষ্কার তাদের বিস্মিত করেছে। স্কুলছাত্র সাইফুল, দিদার আলম জানায়, আমাগো শাওন ভাই যে প্লেন বাইনাইছে হেইডা দেইখা আমাগোর বানাইতে ইচ্চা করছে। এ দুই ছাত্রের মতো শতশত ছাত্র-ছাত্রী এখন নতুন কিছু আবিষ্কার করার চিন্তা করছে। তাদের বক্তব্য শাওন সি-প্লেন বানাতে পারলে আমরাও অন্য কিছু তৈরি করবো।
শাওনের পিতা মো. নাসির উদ্দিন বলেন, বাসায় বসে সারাদিনই কিছু না কিছু নতুন করার চেষ্টা শাওনের মধ্যে। তবে শাওন যে সি-প্লেন তৈরি করে ফেলবে এটা কল্পনাও করিনি।
শাওনের মামা সাংবাদিক মনিরুল ইসলাম জানান, শুক্রবার সি-প্লেনটি পরীক্ষামূলক চালানো হয়। আর কিছুদিন পর কলাপাড়া উপজেলা প্রশাসনের শীর্ষ কর্মকর্তাদের উপস্থিতিতে এটা উড্ডয়ন করার পরিকল্পনা রয়েছে।