জীবিকার তাগিদে সীমান্তে হারিয়ে যায় যাদের স্বপ্ন!

আজিজুল ইসলাম, ফুলতলা সীমান্ত থেকে ফিরে: ঈদের আগে ভারত থেকে গরু আনতে যেয়ে লাশ হয়ে ফেরেন জুড়ী উপজেলার আবুল কালাম। চার অবুঝ হুরুতা (সন্তান) আর বুড়া হউর (শ্বশুড়), হড়ী (শ্বাশুড়ী) লইয়া কই যাইতাম? অনিশ্চিত জীবনের কথা বলতে গিয়ে স্ত্রী রেজিয়া বেগমের (৩০) চোখ ছলছল করে উঠে। ঈদের মাত্র দু’দিন আগে সকল আনন্দ হতাশায় মিশে যায় মৌলভীবাজারের জুড়ী উপজেলার ফুলতলা ইউনিয়নের পুর্ব বটুলী গ্রামের আবুল কালামের পরিবারের।

Fultola (5)-1
একমাত্র উপার্জনক্ষম ব্যক্তিকে হারিয়ে নির্বাক পুরো পরিবার

গত ২৩ সেপ্টেম্বর আবুল কালামের (৩৫) লাশ পাওয়া যায় ফুলতলা সীমান্তের ১৮২৫ নম্বর সীমান্ত পিলার এলাকায় একটি ব্রীজের নীচে। সরেজমিন মঙ্গলবার পুর্ব বটুলী গ্রামে আবুল কালামের বাড়িতে গেলে গোটা পরিবারকে শোক ও হতাশাগ্রস্ত দেখা যায়। ঈদের পরে গোটা এলাকায় যখন উৎসবের আমেজ তখন সীমান্তের জিরো লাইনে কালামের পরিবারজুড়ে বোবা কান্না। অবুঝ ৪টি সন্তান বুঝতে পারেনি তাদের বাবা আর ফিরে আসবে না। কালামের ৪ সন্তানের মধ্যে বড় ছেলে আবু সাঈদ ৭ম শ্রেণির ছাত্র, ২য় মেয়ে পড়ে ৪র্থ শ্রেণিতে, ৩য় ছেলে কিবরিয়া ২য় শ্রেণিতে এবং সবছোট মেয়ে সাদিকা এখনও স্কুলমুখি হয়নি। বৃদ্ধ বাবা ফিরোজ আলী (৮৪) এবং মা তেরাবান বিবি (৭০) এই ৮ জনের সংসারে নিহত আবুল কালাম ছিল একমাত্র উপার্জনক্ষম ব্যক্তি।

পুত্রশোকে ফিরোজ আলী শুধু হাউমাউ করে কাঁদছেন। ছেলে কীভাবে মারা গেলো তা জানেন না। ছেলের মৃত্যুর পর আশপাশের মানুষ তাদের কিছুটা সাহায্য করেছে। সেই সাহায্যে এখন চলছে। কিন্তু কয়দিন পর কীভাবে চলবে? তার উত্তর জানা নেই ফিরোজ আলীর। তিনি কান্নায় ভেঙে পড়েন।

নিহত আবুল কালামের বড় ভাই মো: চেরাগ আলী জানান, ২১ সেপ্টেম্বর সন্ধ্যার পর বাড়ি থেকে বেরিয়ে যায় আবুল কালাম। ২৩ সেপ্টেম্বর ভারতীয় অংশে লাশ পড়ে থাকতে দেখে টহলরত বিজিবিকে তারা জানান। বিজিবি সদস্যরা ভারতীয় বিএসএফের সাথে যোগাযোগ করলে তারা লাশ উদ্ধার করে নিয়ে যায় এবং ভারতে লাশের ময়নাতদন্ত শেষে ওই দিন রাতেই লাশ আনুষ্ঠানিকভাবে ফেরৎ দেয়।

স্থানীয় লোকজন নাম প্রকাশ না করার শর্তে জানান, ঈদের আগে একটি গরু ভারত থেকে আনতে পারলে হাজার দশেক টাকা লাভের আশায় কালাম অবৈধভাবে সীমান্ত অতিক্রম করে। কিন্তু একটা মানুষকে সেখানে হত্যা করে ব্রীজের নীচে ফেলে রাখাটা অমানবিক। নিহত আবুল কালামের গায়ে কোনো গুলির চিহ্ন পাওয়া যায়নি। তবে শরীরে কাটা তাঁরের বেড়ার ক্ষতচিহ্ন ছিল। ভারতীয় অংশে লাশের ময়নাতদন্ত হলেও দেশে ময়নাতদন্ত ছাড়াই পরিবারের কাছে লাশ হস্তান্তর করা হয়। ফলে মৃত্যুর সঠিক কোন কারণ পরিবার জানতে পারবে না। পাবে না কোনও ক্ষতিপূরণ।

স্থানীয় লোকজন আরও জানান, যারা মূল গরু চোরাকারবারী তারা ধরা ছোঁয়ার বাইরে থেকে যায় আর মারা যায় কালামের মতো অভাবের তাড়নায় এপথে পা বাড়ানো মানুষ। করিডোরের নামে ৫শ টাকায় ভারতীয় গরুর বৈধতায় অনেকে লোভে ভারত থেকে গরু আনতে উৎসাহী হয়। করিডোর প্রক্রিয়াটাই বন্ধ করা উচিত বলে স্থানীয় লোকজনের দাবি। নয়তো কালামের মতো আরও অনেককেই জীবন দিতে হবে।

সরেজমিন পরিদর্শণকালে বিজিবির টহল দল এ ব্যাপারে কোনো মন্তব্য করেনি। এ ব্যাপারে জানতে ফুলতলা বিজিবি ক্যাম্পে গেলে কোম্পানী কামান্ডার নায়েক সুবেদার হাবিবুর রহমানকে পাওয়া যায়নি। টেলিফোনে যোগাযোগ করলে তিনি ব্যস্ততা দেখিয়ে এড়িয়ে যান এবং সংযোগ বিচ্ছিন্ন করে দেন।

ফুলতলা ইউনিয়নের চেয়ারম্যান ফয়াজ আলী জানান, আমরা মাসে মাসে এলাকায় এবং ইউনিয়নে আইন শৃঙ্খলা সভা করে মানুষকে সতর্ক করি। তারপরও তারা যখন যায়, তখন এই পরিণতি হতেই পারে। করিডোরে ভারতীয়রা এনে গরু দেবে, এখানে ভারত থেকে গরু আনতে যাওয়ার কোন কারণ নাই।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.