অবহেলায় প্রাণ হারালো নড়বড়ে কমিউনিটি ক্লিনিক

মিলন কর্মকার রাজু, কলাপাড়া (পটুয়াখালী): দরজা-জানালা ভাঙা, ছাদ ও দেয়ালের পলেস্তারা খসে পড়ে স্তূপ হয়ে আছে। দালানের ভেতরে মল-মূত্র বিড়ি-সিগারেটের টুকরো। ওষুধের কার্টুনগুলো খোলা আর এলোমেলো পড়ে আছে মেঝেতে।

Community clinic shut down in Kalapara
জরাজীর্ণ ভবনে চলছিল কমিউনিটি ক্লিনিক, সংশ্লিষ্টদের অবহেলায় বন্ধ হয়ে গেছে এর কার্যক্রম।

এ চিত্র পটুয়াখালীর কলাপাড়ার কচ্ছপখালী কমিউনিটি ক্লিনিকের। গত পাঁচ মাস ধরে এ ক্লিনিকে সব ধরনের চিকিৎসা সেবা বন্ধ  থাকলেও উপজেলা স্বাস্থ্য প্রশাসক ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা এ বিষয়ে কিছুই জানেন না। ক্লিনিক বন্ধ হয়ে যাওয়ায় স্থানীয় দরিদ্র মানুষরা চিকিৎসা সেবা থেকে বঞ্চিত।

ক্লিনিকের দায়িত্বরত কমিউনিটি হেলথ সার্ভিস প্রোভাইডার (সিএইচসিপি) মাহমুদা ইয়াসমিন গত ২২ জুন থেকে ছয় মাসের মাতৃত্বকালীন ছুটিতে রয়েছেন। স্বাস্থ্য সহকারী মো. আলী হোসেন এক বছরেরও বেশি সময় আগে অন্যত্র বদলি হয়ে চলে গেছেন। পরিবার কল্যাণ সহকারী হাবিবা আক্তারের সপ্তাহে তিনদিন ডিউটি থাকলেও তিনিও ক্লিনিকে আসেন না বলে অভিযোগ এলাকাবাসীর।

স্থানীয়দের অভিযোগ, গত জুন মাসের পর এলাকার কেউই এই ক্লিনিকে স্বাস্থ্য সেবা পায়নি। আগে প্রতিদিন এখানে ২৫/৩০ জন গর্ভবতী মা ও শিশু চিকিৎসা সহায়তা পেতো। ২০১৪ সালের ৩০ অক্টোবরের পর গত ১৩ মাসে কমিউনিটি ক্লিনিকে কোনো ওষুধ দেয়নি উপজেলা স্বাস্থ্য বিভাগ।

সরেজমিনে গিয়ে দেখা যায়, কমিউনিটি ক্লিনিকের সামনে কয়েকজন নারী অপেক্ষা করছেন ডাক্তারের জন্য। এদের একজন সুফিয়া বেগম। বললেন, “চাইর দিন ধইর‌্যা আই। কিন্তু এইহানে কেউরেই দেহি না”। ছয় মাসের অন্তঃসত্ত্বা এই নারী বলেন, “দেড় মাইল হাইট্টা আইছি। রোজই হুনি আইজ এইডা (কমিউনিটি ক্লিনিক) খুলবে। কিন্তু রোজ আইয়া ফিইর‌্যা যাই। এইডা যদি নাই খোলে তয় মোগে এইহানে আইতে কয় কা স্বাস্থ্য আপারা।”

কচ্ছপখালী গ্রামের বাসিন্দা আবুল বসার জানান, ‘এই ভবন শ্যাষ কবে খোলছে হেইডা মনে নাই। তবে মাঝে মাঝে একজন টিকা দেতে আয়। কিন্তু দরজা খোলে না।’ তিনি জানান, ভবনের যে অবস্থা তাতে যে কোনো মুহূর্তে ধসে পড়তে পারে। আর ভবনের ভেতরে যে অবস্থা খুবই শোচনীয়।

প্রতিটি কমিউনিটি ক্লিনিকে প্রতি মাসে একজন ডাক্তার ক্লিনিকে বসে রোগী দেখার নিয়ম থাকলেও এখানে গত পাঁচ মাসে একজন ডাক্তারও আসেনি। এ কারণ বাধ্য হয়ে রোগীদের তুলাতলী ২০ শয্যা হাসপাতাল ও কলাপাড়া উপজেলা হাসপাতালে গিয়ে চিকিৎসা নিতে হচ্ছে। গ্রামীণ মানুষের স্বাস্থ্যসেবায় প্রত্যন্ত এলাকায় এই কমিউনিটি ক্লিনিক নির্মাণ করা হলেও এখন এটি কোনো কাজে আসছে না।

সিএইচসিপি মাহমুদা ইয়াসমিন জানান, আগামী ২২ ডিসেম্বর তার ছুটি শেষ হওয়ার পর তিনি আবার কাজে যোগদান করবেন। এতদিন ক্লিনিক বন্ধ ছিল তা তিনি জানেন না।

পরিবার কল্যাণ সহকারী হাবিবা আক্তার বলেন, তিনি টিকা দেওয়ার সময় ক্লিনিকে যান। তবে ওষুধ না থাকায় এবং সিএইচসিপি ছুটিতে থাকায় ক্লিনিক খোলা হয় না। তাছাড়া ভবনের অবস্থা খুব খারাপ তাই একা বসতে ওইখানে ভয় করে।

এলাকাবাসী বলেন, সিএইচসিপি মাহমুদা ইয়াসমিন মাতৃত্বকালীন ছুটিতে থাকলেও তার স্থানে আরেকজনকে দায়িত্ব দেয়া উচিত ছিল। তাহলে এই পাঁচ মাস এলাকাবাসী চিকিৎসা ও ওষুধ পেত। এভাবে ক্লিনিক বন্ধ করে রাখা ঠিক হয়নি।

ক্লিনিক সংলগ্ন কচ্ছপখালী সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের ছাত্র-ছাত্রীরা জানান, এই জায়গায় এখন আর মানুষ আসে না। ভাঙা জানালা দিয়ে ঢুকে বড় ছেলেরা ভেতরে বসে সিগারেট খায়, কেউ কেউ পায়খানা করে। আর ক্লিনিকটি সব সময়ই বন্ধ থাকে।

কলাপাড়া উপজেলা পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা মো. শাহ আলম হাওলাদার বলেন, কমিউনিটি ক্লিনিক তদারকি করেন স্বাস্থ্য বিভাগ। তাদের একজন পরিবার কল্যাণ সহকারী ওই ক্লিনিকে কাজ করেন সপ্তাহে তিন দিন। তবে তিনি কেন ক্লিনিকে বসেন না বিষয়টি দেখবেন বলে জানান।

উপজেলা স্বাস্থ্য প্রশাসক ডা. লোকমান হাকিম জানান, ওই কমিউনিটি ক্লিনিকের সিএইচসিপি ছুটিতে আছেন। তবে পাঁচ মাস ক্লিনিকটি বন্ধ তা তিনি জানেন না। প্রতিমাসে কমিউনিটি ক্লিনিক ভিজিট ও একজন ডাক্তারের ওই ক্লিনিকে যাওয়ার নিয়ম থাকলেও কেন যাচ্ছেন না জানতে চাইলে তিনি বলেন, আমি ছয় মাস আগে এসেছি এ কারণে নলেজে এ বিষয়টি নেই। তবে সিএইচসিপি সংকট থাকায় ওই খানে অন্য কাউকে দায়িত্ব দিতে না পারায় ক্লিনিকটি বন্ধ থাকতে পারে।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.