দিনাজপুরে এবার লিচুর ভালো ফলন, বাজারে উঠতে শুরু করেছে

রতন সিং, দিনাজপুর: দিনাজপুরে মধু মাস গ্রীষ্মকালে লিচু বাগানে গাছে গাছে লিচুর ব্যাপক সমারোহ ও পাকা লিচুর সুগন্ধে এখন মুখরিত। মৌমাছিরা লিচুর ঘ্রাণ নিতে বাগানে ভোঁ ভোঁ শব্দে লিচু গাছের এ ডাল থেকে ও ডালে উড়ান দিচ্ছে। এ অঞ্চলের সুস্বাদু বেদেনা লিচু জ্যৈষ্ঠ মাসের প্রথমেই বাজারে উঠবে। বর্তমানে দেশি প্রজাতির মাদ্রাজী লিচু বাজারে উঠছে। দেশি প্রজাতির বোম্বে ও অন্যান্য লিচু বাজারে উঠার অপেক্ষায় রয়েছে।

20160510_125103.psd
দিনাজপুরে বাগানগুলোতে নানা জাতের লিচু পাকতে শুরু করেছে

সরেজমিন লিচু বাগানগুলোতে গিয়ে বাগানীদের সাথে কথা বলে জানা গেছে, এবারে অতি মাত্রায় তাপদাহ ও জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে বৃষ্টির অভাব এবং তীব্র রোদের কারণে লিচুর গুটি ঝরে যাওয়ার পরেও যে সব লিচু এখনও গাছে রয়েছে তাতে লিচুর ভালো ফলনের সম্ভাবনা রয়েছে।

ফলন ভালো পাওয়ার আশায় বাগান মালিক ও বাগান ক্রয় করে ব্যবসায়ীরা পরিচর্যায় ব্যস্ত রয়েছে। লিচুর ফুল ও মুকুল আসার শুরু থেকেই গাছের গোড়ায় ও গাছের ডাল ও আগায় পানি দেওয়া, গাছের খাবার হিসেবে জৈব ও রাসায়নিক সার এবং গাছে প্রয়োজন অনুযায়ী নিয়মিত স্প্রে করে পরিচর্যা করা হয়েছে। মৌসুমের শেষে এ মধু মাসে দেশি জাতের মাদ্রাজি লিচু কেবল মাত্র বাজারে উঠতে শুরু করেছে। মাদ্রাজি ও দিনাজপুরের বিখ্যাত বেদেনা লিচু জ্যৈষ্ঠ মাসের প্রথম মাসে বাজারে আসবে। বেদেনা লিচু ক্রয়ের জন্য গ্রাহকেরা অধিক আগ্রহে অপেক্ষা করছে। জনশ্রুতি রয়েছে বেদেনা লিচুর ব্যাপক চাহিদা থাকায় বাজারে উঠার পূর্বেই বাগান থেকে ক্রেতারা নিয়ে যায়।

দিনাজপুর জেলার সদর, বিরল, চিরিরবন্দর, বোচাগঞ্জ, বীরগঞ্জ, খানসামা, পার্বতীপুর, ফুলবাড়ী ও বিরামপুর উপজেলাসহ ১৩টি উপজেলাতেই কম বেশি লিচুর বাগান রয়েছে। এসব বাগানে মাদ্রাজী, চায়না, বোম্বাই, কাঠালী আর দেশি জাতের লিচুতে ছেঁয়ে গেছে। বিগত বছরগুলোতে লিচু বাগানের মালিকেরা লিচু চাষে ব্যাপক লাভবান হওয়ায় লিচুর বাগান করার চাহিদাও বেড়ে গেছে।

গত বছর প্রাকৃতিক দুর্যোগ ও রাজনৈতিক কারণে হরতাল-অবরোধ থাকায় যানবাহন না চলায় দিনাজপুরের লিচু অন্যত্র প্রেরণ করতে না পারায় লিচু বাগানের মালিক ও ব্যবসায়ীরা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। গত বছরের ক্ষতি পুষিয়ে নেওয়ার জন্য লিচু বাগানের মালিকেরা এবারে লিচু পরিচর্যায় ব্যস্ত রয়েছে। তবে অতিমাত্রায় ক্ষরা, তাপদাহ ও বৃষ্টি না হওয়ায় লিচু ফলের কিছুটা ক্ষতি হয়েছে।

অনুসন্ধান নিয়ে ও বাগান মালিকদের সাথে কথা বলে জানা গেছে, চায়না থ্রি, চায়না ফোর ও বোম্বে জাতের লিচু ফেটে গেছে। ফেটে যাওয়া রোধ করতে লিচু গাছে নিয়মিত পানি স্প্রে করা হচ্ছে। তাপদাহ কমে গেলে লিচুর এ ধরনের ক্ষতি না হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। জ্যৈষ্ঠ মাসের প্রথম থেকে পর্যায়ক্রমে সব ধরনের লিচু বাজারে উঠবে। সবশেষে চায়না থ্রি, চায়না ফোর ও দেশি জাতের কাঠালী লিচু বাজারে এসেছে। নতুন মাদ্রাজী লিচু বাজারে দেড়শ থেকে ১৮০ টাকা শতে বিক্রি হচ্ছে। তবে বেদেনা লিচু ৫শ থেকে ৬শ টাকার নিচে পাওয়া যাবে না। চায়না থ্রি ও চায়না ফোর একই দামে বিক্রি হয়।

দিনাজপুর সদর উপজেলার কসবা এলাকার লিচুর বাগানের মালিক আনিসুর রহমান জানান, হরতাল, অবরোধ না থাকলে ও রাজনৈতিক পরিস্থিতি স্বাভাবিক থাকলে এবং পরিবহন সমস্যা না হলে গতবারের লোকসান পুষিয়ে নেওয়া যাবে। এখন পর্যন্ত আবহাওয়া অনুকূলে রয়েছে। বাইরের ঢাকা, চিটাগাং, সিলেটসহ বিভিন্ন জেলার লিচু ব্যবসায়ীরা অনেকে আগাম বাগান কিনে রেখেছেন। তবে এবারে হরতাল-অবরোধ ও পরিবহন সমস্যা কম হওয়ার সম্ভাবনা থাকায় লিচু ব্যবসায়ীরা লাভের আশা করছেন।

অন্য দিকে দিনাজপুর চুনিয়াপাড়া দেবীপুর নামকস্থানে বাগান মালিক এ্যাডঃ শামীম আলী সরকার জানান, গতবারের তুলনায় এবারে লিচুর ফলন আমার বাগানে অনেকটাই কম। বৃষ্টি কম হওয়া ও রোদের কারণে মুকুল ঝড়ে যাওয়ায় ফলন কম হওয়ার আশংকা রয়েছে। নিরাপত্তা বিষয়ে বর্তমানে কোন সমস্যা নেই। তবে মাঝে মধ্যে দুর্বৃত্তরা লিচুর বাগান লুট করে নেয়। তবে এবারে আমাদের সতর্ক দৃষ্টি রয়েছে। লিচুর বাগানের পরিচর্যাকারী আবু বকর হিরা ও রহমত আলীর সাথে কথা বললে তারা বলেন, আমরা বাগানের মালিকদের লিচু পরিচর্যা করে প্রতিদিন ৩শ টাকার মত মজুরি পাই। তবে এবারে লিচুর ফলন গত বারের তুলনায় এখন পর্যন্ত ভালো।
এদিকে লিচু সংরক্ষণের কোনও ব্যবস্থা না থাকায় প্রতি বছরই ব্যাপকহারে লিচু নষ্ট হয়। এ ব্যাপারে দিনাজপুর চেম্বার অব কমার্স এর সভাপতি মোসাদ্দেক হুসেন জানান, দিনাজপুরের লিচু, আম এবং শাক-সবজি সংরক্ষণের জন্য কোন বিশেষায়িত হিমাগার নেই। চেম্বার থেকে উদ্যোক্তাদের বিশেষায়িত হিমাগার তৈরির জন্য আমরা অনুপ্রাণিত করে আসছি।

দিনাজপুর জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপ-পরিচালক গোলাম মোস্তফা জানান, আবহাওয়া অনুকূলে থাকায় এবার লিচুর বাম্পার ফলন হয়েছে।

দিনাজপুরের ১৩টি উপজেলায় এবার ৪ হাজার ১শ হেক্টর জমিতে লিচুর আবাদ করা হয়েছে। উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে ২৬ হাজার মেট্রিক টন। অতি তাপদাহ ও অনাবৃষ্টির কারণে লিচু ফল গাছে ফেটে যাচ্ছে এ বিষয়ে তিনি বলেন, এ ধরনের কিছু সমস্যা থাকে। তবে খুব বেশি একটা ক্ষতিগ্রস্ত হবে না। লিচু বিদেশে পাঠানোর ব্যাপারে প্রশ্ন করা হলে তিনি বলেন, লিচু ২/৩ দিনের মধ্যে কালার বদলে যায় এবং সংরক্ষণের কোনও ব্যবস্থা না থাকায় বিদেশে পাঠানো সম্ভব হচ্ছে না।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.