রসুলপুর গণহত্যা দিবস: একই পরিবারের ৬ জনকে পুড়িয়ে মেরেছিল পাকহানাদাররা

আতাউর রহমান মিন্টু, গফরগাঁও (ময়মনসিংহ): গফরগাঁও পৌরশহর থেকে প্রায় ১৫কিলোমিটার দূরে রসুলপুর বাজার। সেই বাজার থেকে ২০/৩০ গজ পশ্চিমে বৃক্ষ-লতায় ঘেরা কায়স্থ বাড়ি। একাত্তরের এক ভোর রাতের ঘটনা। মসজিদে তখনো মোয়াজ্জিনের কণ্ঠে আযানের ধ্বনি উচ্চারিত হয়নি। রাতজাগা পাখিরা তখনো ঘরে ফিরেনি। কিন্তু রাতের সেই নিস্তব্ধতাকে পায়ের তলায় মারিয়ে হানাদার পাক সেনাদের বুটের ধপধপ শব্দে কায়স্থ বাড়ির মাটি কেঁপে উঠে। যমদূতের দল কড়া নাড়ে নিশিরঞ্জন ধরের ঘরের দরজায় । দরজা খুলতেই হুরমুর করে ঘরে ঢুকে পাক হানাদার ও তাদের সহযোগী এ দেশীয় রাজাকারের দল পৈশাচিক নৃশংসতায় মেতে উঠে। পুড়িয়ে মারে একই পরিবারের ৬ সদস্যকে।

gafargaon pic-1.31.05.16.
রসুলপুর গ্রামে ১৯৭১ সালে পাক হানাদাররা যেস্থানে ঘরের ভিতর আগুন দিয়ে পুরিয়ে মেরেছেল একই পরিবারের ৬ সদস্যকে

সরেজমিন এলাকাবাসী ও নিশিরঞ্জন ধরের পরিবারের সদস্যদের সাথে কথা বলে জানা যায়, ১৯৭১ সালের ১জুন এই বাড়িতেই ঘটে ইতিহাসের নির্মম, নৃশংসতম এক ঘটনা। ইপিআর-এর ৩/৪জন মুক্তিযোদ্ধা সদস্য পালিয়ে এসে এই কায়স্থ বাড়িতে আশ্রয় নেন। এই ‘অপরাধে’ পাক হানাদার বাহিনী ১৯৭১ সালের ১জুন মঙ্গলবার ভোর রাতে এই বাড়িতেই ঘটায় নির্মম এক হত্যাযজ্ঞ। এই হত্যাযজ্ঞে কায়স্থ বাড়ির প্রধান কর্তা নিশিরঞ্জন ধর (৬০), শিশির কুমার ধর (৫৫), শিষ রঞ্জন ধর (৫২), ভাগিনা স্কুল শিক্ষক রতন কুমার রায় (৪০), ভাতিজা হরিবল চন্দ্র দেব (৫০) ও সন্তোষ কুমার ধরকে (৫০) ঘরের ভিতর খুঁটির সাথে পিছমোড়া করে বেঁধে জীবন্ত অগ্নিদগ্ধ করে হত্যা করে হানাদার বাহিনী।  হত্যাযজ্ঞ থেকে গুরুতর আহত অবস্থায় পালিয়ে যেতে সক্ষম হন পরিবারের দুই সদস্য খোকন কুমার রায় (২২) ও রবিন্দ্র চন্দ্র দেব (৪০)। পরে সুস্থ হয়ে রবিন্দ্র চন্দ্র দেব সক্রিয়ভাবে মুক্তিযুদ্ধে অংশ গ্রহণ করেন।

নিশিরঞ্জনের প্রতিবেশী ও নারকীয় এই ঘটনার প্রত্যক্ষদর্শী মোঃ হাফিজ উদ্দিন (৬২) ঘটনার বর্ণনা দিয়ে বলেন, ঐ দিন ভোর রাতে হৈচৈ ও কান্নাকাটি শুনে আমরা ঘর থেকে বের হয়ে দেখি কায়স্থ বাড়ি দাউ দাউ করে জ্বলছে। আগুনের শিখায় আকাশ লাল হয়ে উঠেছে। দূরে অনেক মানুষ রাস্তার পাশে দাড়িয়ে স্তব্ধ হয়ে নৃশংস এই ঘটনা দেখছে। কারো শব্দ করার উপায় নেই। কারণ বাড়ি ঘিরে রেখেছে  হানাদার পাকিস্তানী সৈন্যরা ও এদেশীয় রাজাকাররা। ঘটনা শেষ করে সকালের দিকে ঘাতকের দল চলে যাওয়ার পর আমরা গিয়ে দেখি কায়স্থ বাড়ির প্রধান নিশিরঞ্জন ধরসহ ৬ জনকে ঘরের ভিতর আটকে, দরজা জানালা বন্ধ করে আগুনে পুড়িয়ে হত্যা করা হয়েছে। রসুলপুর গ্রামের অসিত কুমার দেব (৫৯) বলেন, চোখের সামনে পাকিস্তানী হানাদার ও এদেশীয় রাজাকাররা আমাদের পরিবারের ৬ জনকে আগুনে পুড়িয়ে মেরেছে। তাদের অপরাধ ছিল মুক্তিবাহিনী ও ৩ জন ইপিআর সদস্যদের আশ্রয় দেওয়া। পাকিস্তানী হানাদার বাহিনী ঘরের ভিতর হাত-পা বেঁধে আমাদের পরিবারের ৬ জনকে আগুনে পুড়িয়ে হত্যা করে বাড়ির পাশে জঙ্গলে স্তুপ আকারে সাজিয়ে লাশগুলোতে আবার আগুন লাগিয়ে চলে যায়।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.