দিনাজপুরের দুটি পিস স্কুল গোয়েন্দা নজরদারিতে

রতন সিং, দিনাজপুর: সরকারি অনুমতি ছাড়াই দিনাজপুর শহরে পিস নামের দুটি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান চলছে। জাতীয় পাঠক্রমের পাশাপাশি স্কুল কর্তৃপক্ষ নিজস্ব পদ্ধতিতে শিক্ষার্থীদের বিভিন্ন বিষয়ে শিক্ষা দিচ্ছে। স্থানীয়ভাবে পরিচালনা পর্ষদ থাকলেও ভারতীয় ইসলামিক বক্তা ও পিস টিভির উদ্যোক্তা ডা. জাকির নায়েকের অনুপ্রেরণাতে এসব স্কুল গড়ে উঠেছে বলে জানা গেছে।

গুলশান হামলার পর ডা. জাকির নায়েকের বক্তৃতা থেকে যুবকরা জঙ্গি তৎপরতায় উদ্বুদ্ধ হচ্ছে এমন অভিযোগ আসলে বাংলাদেশে পিস টিভির সম্প্রচার বন্ধ করে দেয় সরকার। এরপর দিনাজপুর পুলিশ প্রশাসন অননুমোদিত স্কুল দুটি গোয়েন্দা নজরদারিতে এনেছে বলে জানা গেছে।

অনুসন্ধানে জানা গেছে, দিনাজপুর উপশহরের ১নং ব্লকে একটি তিনতলা বাড়ি ৫২ হাজার টাকা মাসিক ভাড়া নিয়ে ২০১৪ সালের জানুয়ারি থেকে পিস নামের একটি স্কুল চালু করা হয়। এই স্কুলে প্লে থেকে ৬ষ্ঠ শ্রেণি পর্যন্ত নয়টি শ্রেণিতে ৩১৭ জন শিক্ষার্থী রয়েছে। শহরের ঈদগাহ বস্তি এলাকায় নিউ পিস স্কুল নামে আরেকটি প্রতিষ্ঠান চলছে। স্কুল দুটিতে পর্যাপ্ত সংখ্যক শিক্ষক ও কর্মচারী রয়েছে। প্লে থেকে নার্সারি, কেজি এবং প্রথম শ্রেণি থেকে ষষ্ঠ পর্যন্ত নয়টি শ্রেণিতে শিক্ষার্থীদের পাঠ দান করা হচ্ছে। ইংরেজি ভার্সনে জাতীয় কারিকুলামকে অনুকরণ করা হলেও স্কুলের নিজস্ব বইয়ের সংখ্যাই বেশি।

পিস স্কুলের প্রশাসনিক কমকর্তা কামরুল ইসলাম জানান, সরকারি বিধি ও শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের প্রকাশিত কারিকুলাম অনুযায়ী পাঠদান করা হয়। শিক্ষার্থীদের পোশাক ভারতের ইসলামিক বক্তা জাকির নায়েকের অনুকরণে প্যান্ট, চেক শার্ট, টাই ও মাথায় টুপি ব্যবহার করা হয়। সূত্রটি জানায়, ওই বিদ্যালয়ে ৩০ জন শিক্ষক ও ১৬ জন কর্মচারী রয়েছে। এছাড়াও বিদ্যালয়ে আসা যাওয়ার জন্য শিক্ষার্থীদের একটি অত্যাধুনিক স্কুল বাস রয়েছে।

শুরু থেকেই এই বিদ্যালয়ে ক্লাশরুম ও অফিসরুমে উন্নতমানের ডেকোরেশন করে শিক্ষা কার্যক্রম চালু রয়েছে। স্কুলের মাসিক ব্যয় ৩ থেকে সাড়ে ৩ লাখ টাকা। আয়ের খাত শুধুমাত্র শিক্ষার্থীদের নিকট থেকে আদায়কৃত বেতনের টাকা ছাড়া আর অন্য কিছু নেই।

শিক্ষার্থীদের নিকট থেকে বেতন গ্রহণের বিষয়ে খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, প্লে থেকে নার্সারি পর্যন্ত মাসিক বেতন ৮০০ টাকা, প্রথম থেকে দ্বিতীয় শ্রেণি পর্যন্ত ১ হাজার ২০০ টাকা, তৃতীয় থেকে চতুর্থ শ্রেণি পর্যন্ত ১ হাজার ৫০০ টাকা এবং ৫ম থেকে ৬ষ্ঠ শ্রেণি পর্যন্ত ২ হাজার টাকা বেতন নেওয়া হয়। গত আড়াই বছরে বিদ্যালয়ে কোনো মুনাফা হয়নি। শিক্ষার্থীদের নিকট থেকে আদায়কৃত অর্থ দিয়েই বিদ্যালয়ের খরচ পরিচালিত হয় বলে জানান সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তা।

অনুসন্ধানে আরো জানা যায়, বিদ্যালয়ের শিক্ষকদের মধ্যে অধিকাংশই ছাত্রজীবন থেকে জামায়াতের রাজনীতির সাথে জড়িত ছিল। পরিচালনা পর্ষদের সভাপতি প্রকৌশলী মো. ফজলুর রহমান নিজে কোনো রাজনৈতিক দলের সাথে সম্পৃক্ত নন বলে জানান। তবে তার এলাকায় জনশ্রুতি রয়েছে তিনি জামায়াতের রাজনীতিকে সমর্থন করেন। নয় সদস্য বিশিষ্ট পরিচালনা পর্ষদের সকলেই জামাত ঘরানার।

চলতি বছরের জানুয়ারি মাসে চালু হওয়া নিউ পিস স্কুলে শিক্ষকের সংখ্যা ১৫ এবং কর্মচারীর সংখ্যা ১৮। শিক্ষার্থী রয়েছে ৬০ জন। একটি দোতালা বাড়ি ৪২ হাজার টাকা মাসিক ভাড়া নিয়ে স্কুলটি চলছে। শিক্ষার্থীদের বেতন একই পদ্ধতিতে নেওয়া হচ্ছে। স্থানীয় ১৮ সদস্যের একটি পরিচালনা পর্ষদ রয়েছে। পরিচালনা পর্ষদের চেয়ারম্যান আলমগীর হোসেন নিজে জামায়াতের রাজনীতির সাথে সম্পৃক্ত রয়েছেন। স্কুলের প্রশাসনিক কর্মকর্তা আজমীর হোসাইন দাবি করেন, স্কুল পরিচালনা পর্ষদের কেউই কোনো রাজনীতি দলের সাথে সম্পৃক্ত নয়। পিস নামকরণের কারণেই স্কুলটি বিতর্কের মুখে পড়েছে।

স্কুল প্রতিষ্ঠার সময় সকল পরিচালনা পর্ষদের সদস্যদের ১ লাখ টাকা করে দেওয়া অর্থে স্কুলের আসবাবপত্র ক্রয় ও ডেকোরেশন করা হয়েছে। স্কুলে ইংলিশ ভার্সনে জাতীয় কারিকুলাম ও কোরআন-হাদিসের আলোকে পাঠদান করা হচ্ছে।

দিনাজপুর জেলা প্রাথমিক শিক্ষা কর্মকর্তা সমেশ মজুমদার জানান, মন্ত্রণালয়ের নির্দেশ অনুযায়ী সকল সরকারি-বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে বিনামূল্যে বই প্রদানের নিদের্শেনা রয়েছে। সেই আলোকে দিনাজপুর শহরে দুটি পিস স্কুলে শিক্ষার্থীদের বই সরবরাহ করা হয়েছে। বেরসাকারি বিদ্যালয়গুলো কোনো অনুমতি ছাড়াই পরিচালিত হয়ে আসছে। তিনি বলেন, ‘এই দুটি বিদ্যালয়ের বিরুদ্ধে বিভিন্ন মহল থেকে পাঠদানের বিষয়ে অভিযোগ উঠায় আমরা ওই বিষয়টি খতিয়ে দেখছি’।

দিনাজপুরের পুলিশ সুপার মো. রুহুল আমিন জানান, শহরে অবস্থিত দুটি পিস স্কুলের পাঠ দানের বিষয়ে বিভিন্ন মহল থেকে অভিযোগ উঠায় ওই স্কুল দুটি গোয়েন্দা নজরদারিতে রাখা হয়েছে।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.