চলে গেলেন একাত্তরের দুর্ধর্ষ জলযোদ্ধা রহমত উল্ল্যাহ

প্রতিনিধি, খুলনা:  প্রখ্যাত মুক্তিযোদ্ধা লে. গাজী মোহাম্মদ রহমত উল্ল্যাহ দাদু (অব.) বীরপ্রতীক বুধবার রাত ৯টা ২০ মিনিটে খুলনার শেখপাড়ার নিজ বাসভবনে ইন্তেকাল করেছেন (ইন্নালিল্লাহি… রাজেউন)।

গাজী রহমাতুল্লাহ দাদু দীর্ঘদিন কিডনি ও পিত্তথলির সমস্যায় ভুগছিলেন। এছাড়া ২০০০ সালে তার ওপেন হার্ট সার্জারি করা হয়। বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকদের তত্ত্বাবধানে নগরীর শেখপাড়ার বাসায় তিনি চিকিৎসা নিচ্ছিলেন।

New Image
গাজী মোহাম্মদ রহমত উল্ল্যাহ দাদুর (অব.) মরদেহে খুলনা সিটি করপরেশনের শ্রদ্ধা নিবেদন।

দুর্ধর্ষ এই নৌ যোদ্ধা ১৯৭১ সালের ১৭ ডিসেম্বর সকাল ৬টায় খুলনার সার্কিট হাউজে প্রথম স্বাধীনতার বিজয় পতাকা উত্তোলন করেন।

গাজী মোহাম্মদ রহমাতুল্ল্যাহ দাদু ১৯৩৭ সালের ১১ নভেম্বর পাইকগাছার গড়ইখালিতে জন্মগ্রহণ করেন। ১৯৫৬ সালে তিনি পাকিস্তান নৌ-বাহিনীতে যোগদান করেন। ১৯৬৫ ও ১৯৬৭ সালে তিনি পাক-ভারত যুদ্ধে অংশ নেন। পাকিস্তান নৌ ওবাহিনীতে থাকাকালীন তিনি বিভিন্ন যুদ্ধে বীরত্বপূর্ণ অবদান রাখেন।

১৯৭১ সালের ১৫ আগস্ট প্রথম নৌ-কমান্ডো অপারেশনে চালনা (বর্তমান মোংলা), চট্টগ্রাম, নারায়ণগঞ্জ, চাঁদপুর ও দাউদকান্দিতে অপারেশনে অংশ নেন। ১৬ ডিসেম্বর পর্যন্ত তিনি বিভিন্ন সফল অপারেশনের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। স্বাধীনতা যুদ্ধে তার নেতৃত্বে ১৩২টি জাহাজ ধ্বংস করার কারণে পাকিস্তান হানাদার বাহিনীর নৌপথ এবং সামুদ্রপথে সম্পূর্ণরূপে পর্যুদস্ত হয়েছিল। গেরিলাযুদ্ধে খুলনা, সাতক্ষীরা, বাগেরহাট অঞ্চলে তার আনুমানিক চার হাজারের বেশি যোদ্ধা ছিল। তিনি কপিলমুনি, গড়ইখালি, নীলকমল, চালনা, লক্ষীখোলা, পাইকগাছা, চাপড়া, আশাশুনি, শিয়ালডাঙ্গা, কপিলমুনি ও খুলনায় যুদ্ধে অংশগ্রহণ করেন।

১৭ ডিসেম্বর সকাল ৬টায় তিনি প্রথম খুলনায় স্বাধীনতার পতাকা উত্তোলন করেন। ১৯৭১ সালে ২৬ ডিসেম্বর থেকে ১৯৭২ সালের ৯ জানুয়ারি পর্যন্ত সেক্টর কমান্ডার সম্মেলনে বাংলাদেশ নৌ বাহিনীর এবং ১০ নম্বর সেক্টর কমান্ডার হিসেবে প্রতিনিধিত্ব করেন।

গাজী মোহাম্মদ রহমাতুল্ল্যাহ দাদুর নেতৃত্বে নৌ বাহিনীর গঠন প্রক্রিয়া শুরু হয়। নৌ বাহিনীর সমস্ত কার্যক্রমে নেতৃত্ব দেন তিনি। পাকিস্তান থেকে ফিরে আসা পর্যন্ত নৌ বাহিনীর অফিসার ও নাবিকদের বাংলাদেশে অবস্থানের সকল ব্যবস্থা তিনি করেন।

বঙ্গবন্ধুর প্রত্যাবর্তনের দিন ১৯৭২ সালের ১০ জানুয়ারি গাজী মোহাম্মদ রহমাতুল্ল্যাহ দাদু ঢাকা বিমান বন্দরে নৌ কন্টিজেন্টের গার্ড অব অনার প্রদান করেন। তিনি ইংল্যান্ড থেকে বিএসসি ইঞ্জিনিয়ারিং ডিগ্রি লাভ করেন।

১৯৭৬ সালে চাকরি ছাড়ার পর বাংলাদেশের শিল্প জগতে তিনি বেশ অবদান রাখেন। বরিশাল টেক্সটাইল মিল, রাজশাহী টেক্সটাইল মিল, সুন্দরবন টেক্সটাইল মিল, কুড়িগ্রাম টেক্সটাইল মিল, সিলেট টেক্সটাইল মিল, নোয়াখালী টেক্সটাইল মিল, মাদারীপুর টেক্সটাইল মিল, মাগুরা টেক্সটাইল মিল তার দ্বারা স্থাপন হয়েছিল। ১৯৮৭ সালে তিনি টেক্সটাইল মিল থেকে চাকরি ছাড়ার পর বাংলাদেশের অর্থনৈতিক অগ্রগতির জন্য বেশ অবদান রাখেন।

বাংলাদেশে প্রথম আধা নিবিড় বাগদা চাষ শুরু করেন গাজী মোহাম্মদ রহমাতুল্ল্যাহ দাদু। তিনি প্রথম বাংলাদেশে বাগদার পোনা হ্যাচারি স্থাপন করেন। খুলনা বিভাগীয় চিংড়ি চাষি সমিতির প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি তিনি। এছাড়া তিনি খুলনা বিভাগীয় সেক্টর ফোরামের কোঅর্ডিনেটর ছিলেন।

তার প্রচেষ্টায় নৌ বাহিনীর সমস্ত স্থাপনায় মসজিদ, স্কুল, কলেজ, প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। এছাড়াও বরিশাল, রাজশাহীতে স্কুল, কলেজ প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। পাইকগাছা উপজেলার গড়ইখালি ডিগ্রি কলেজ মসজিদ, মন্দির, স্কুল ও বহু রাস্তাঘাট তার অবদানে হয়।

গাজী মোহাম্মদ রহমাতুল্ল্যাহ দাদুর পরিবার মুক্তিযোদ্ধা পরিবার হিসেবে পরিচিত। তারা ১০ ভাইয়ের মধ্যে সাতজনই মুক্তিযোদ্ধা। এর মধ্যে তার দুই ভাই আইয়ূব ও মুছা মক্তিযুদ্ধে শহীদ হন। ১৯৭১ সালে মহান স্বাধীনতা যুদ্ধে বীরত্বপূর্ণ ও গৌরবোজ্জ্বল অবদানের জন্য বাংলাদেশ সরকার তাঁকে ‘বীরপ্রতীক’ উপাধিতে ভূষিত করেন।

মুক্তিযোদ্ধা লেফট্যানেন্ট গাজী মোহাম্মদ রহমত উল্ল্যাহ দাদু (অব.) বীর প্রতীকের জানাজা

বৃহস্পতিবার (১১ আগস্ট) বাদ জোহর নগরীর শহীদ হাদিস পার্কে অনুষ্ঠিত হয়। এর আগে মরহুমকে গার্ড অব অনার প্রদান করেন মুক্তিযোদ্ধা সংসদ, নৌ বাহিনী ও পুলিশ।

জানাজায় মুক্তিযোদ্ধা, রাজনৈতিক নেতা, প্রশাসনের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা, নৌ বাহিনীর কর্মকর্তাসহ বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষ অংশ নেন। জানাজাশেষে গ্রামের বাড়ি পাইকগাছার গড়ইখালীর পারিবারিক কবরস্থানে দাফন করা হয়েছে।

তার মৃত্যুর খবরে মুক্তিযোদ্ধা সংসদের খুলনা জেলা ও মহানগর নেতারা, বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের নেতারা এবং সামাজিক সংগঠনের প্রতিনিধিরা শেখপাড়ার বাড়িতে যান এবং মরহুমের শোকসন্ত¡প্ত পরিবারের প্রতি সমবেদনা জানান।

তাঁর মৃত্যুতে বিভিন্ন রাজনৈতিক ও শ্রেণি পেশার মানুষ শোক প্রকাশ করে বিবৃতি দিয়েছেন। বিবৃতিদাতারা হলেন, মহানগর বিএনপির প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি এম. নূরুল ইসলাম দাদু ভাই, মহানগর বিএনপির সভাপতি নজরুল ইসলাম মঞ্জু, সাধারণ সম্পাদক সিটি মেয়র মনিরুজ্জামান মনি, খুলনা সিটি কর্পোরেশনের ভারপ্রাপ্ত মেয়র মোঃ আনিছুর রহমান বিশ্বাষসহ প্যানেল মেয়র, কাউন্সিলর ও সংরক্ষিত আসনের কাউন্সিলরবৃন্দ,খুলনা প্রেস ক্লাবের সভাপতি এস এম নজরুল ইসলাম ও সাধারণ সম্পাদক মামুন রেজাসহ কার্যনির্বাহী পরিষদের সদস্যবৃন্দ, খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য প্রফেসর ড. মোহাম্মদ ফায়েক উজ্জামান, খুলনা বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক সমিতির সভাপতি প্রফেসর ড. আহমেদ আহসানুজ্জামান ও সাধারণ সম্পাদক প্রফেসর ড. মো. সারওয়ার জাহান, বাংলাদেশের ওয়ার্কার্স পার্টির পলিট ব্যুরোর সদস্য, খুলনা জেলা সভাপতি কমরেড হাফিজুর রহমান ভূইয়া, সাধারণ সম্পাদক কমরেড এড. মিনা মিজানুর রহমান, পার্টির কেন্দ্রীয় সদস্য কমরেড শেখ সাহিদুর রহমান, ওয়ার্কার্স পার্টির জেলা সম্পাদকম-লীর সদস্য কমরেড আনসার আলী মোল্লা, কমরেড মোজাম্মেল হক, কমরেড দেলোয়ার উদ্দিন দিলু, দখিনা’র প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি ও পাইকগাছা উপজেলা চেয়ারম্যান বিএনপি নেতা বীরমুক্তিযোদ্ধা স. ম. বাবর আলী এ্যাডভোকেট, দখিনা’র সভাপতি প্রফেসর আলী আহমেদ, সিনিয়র সহ সভাপতি আলহাজ্ব মো. আবুবকর সিদ্দিক, সহসভাপতি প্রফেসর ড. মোঃ আব্দুল মান্নান, সহসভাপতি জি এম আঃ হাকিম, সহসভাপতি এ্যাড. হেমন্ত কুমার সরকার, সহসভাপতি মো. ইউনুস আলী গাজী, সহসভাপতি ড. হারুনর রশিদ, সহসভাপতি প্রকৌশলী মোঃ আমজাদ হোসেন, সাধারণ  সম্পাদক প্রকৌশলী রফিকুল আলম সরদার, যুগ্ম সাঃ সম্পাদকবৃন্দ মো. জাহিদ হাবিব ও প্রকৌশলী বেনজির আহমেদ জুয়েল, কোষাধ্যক্ষ এ্যাডঃ মোঃ আবুল কালাম, সাংগঠনিক সম্পাদক এস এম নজরুল ইসলাম,খুলনা টিভি ক্যামেরা জার্নালিস্ট এ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি নিয়ামুল হোসেন কচি, সহ সভাপতি আবু সাঈদ, সাধারণ সম্পাদক হাসান আল মামুন, যুগ্ম সম্পাদক জাকারিয়া হোসেন তুষার প্রমুখ।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.