তারেক এবার যানবাহনে বিদ্যুৎবিহীন হাওয়া দেওয়ার যন্ত্র উদ্ভাবন করলেন

আব্দুল্লাহ আবু এহসান, মধুপুর (টাঙ্গাইল): মধুপুরের তরিকুল ইসলাম তারেক এবার যানবাহনে সাশ্রয়ী বিদ্যুৎবিহীন হাওয়া দেওয়ার কমপ্রেসার যন্ত্র উদ্ভাবন করেছেন।

এর আগে মধুপুরের পাহাড়ী এলাকায় পাম্প টিউবওয়েল উদ্ভাবন করে তারেক সফলতা অর্জন করায় চারদিকে তার সুনাম ছড়িয়ে পড়েছিল। পাম্প টিউবওয়েল ব্যবহারকারীরা উপকৃত হওয়ার পর দিন দিন বৃদ্ধি পায় তার চাহিদা। বাড়ে উৎপাদন। বেড়ে যায় আয় উপার্জন। মনযোগ বাড়ে উদ্ভাবনী কাজে। পাঁচটি পাম্প টিউবওয়েল সফলতার সাথে উদ্ভাবন ও বিপনন করার পর এবার সাশ্রয়ী বিদ্যুৎবিহীন যানবাহনে হাওয়া দেওয়ার কমপ্রেসার যন্ত্রটি উদ্ভাবন করেছেন তিনি।

19-8-2016
বিদ্যুৎবিহীন হাওয়া দেওয়ার কমপ্রেসার যন্ত্র দিয়ে মটর সাইকেলে হাওয়া দিচ্ছেন তারেক।

সরেজমিনে মধুপুর শহর থেকে ৮ কি.মি. উত্তরে মির্জাবাড়ী ইউনিয়নের ভবানিটেকী গ্রামে গিয়ে কথা হয় এ যন্ত্রের উদ্ভাবনকারী তরিকুল ইসলাম তারেকের (৪৫) সাথে। তিনি জানান, পাহাড়ী এলাকার লাল মাটির উঁচুস্থানে যাদের বসবাস তাদের পানি সমস্যার কথা চিন্তা করে ২০০০ সালে পাম্প টিউবওয়েল উদ্ভাবন করি। পাম্পগুলো গুণগত মানসম্পন্ন ও সস্তা হওয়ায় এলাকায় এবং আশেপাশের কয়েক জেলার মানুষের কাছে সমাদৃত হয়। সফলতাও আসে ব্যাপক। রুটি-রুজির পথ খুলে যায়।

মধুপুরে পাহাড়ী এলাকায় ব্যাপক পরিমানে মহিষের গাড়ি, গরুর গাড়ি, ঘোড়ার গাড়ি, ট্রাক, পিকআপ, ভ্যান ও রিক্সাসহ নানা প্রকার যানবাহন মধুপুরের উৎপাদিত কৃষিপণ্য দেশের বিভিন্ন জেলায় সরবরাহের জন্য চলাচল করে। অনেক সময় চাকা থেকে হাওয়া চলে যায়। চাকা ছিদ্র হয়। অনেক সময় বিদ্যুৎ থাকে না। ফলে গাড়িতে হাওয়া দেওয়া সম্ভব হয় না। গাড়ি বা যানবাহন বিকল হয়ে পড়ে। চাকা খুলে মেরামতের জন্য ১০ থেকে ২০ কি.মি. দূরে মধুপুর শহরে নিয়ে যেতে হয়। চাকায় হাওয়া দেওয়ার মতো বিদ্যুতবিহীন কোন যন্ত্র না থাকায় পরিবহন শ্রমিকদের হেনস্তার শিকার হতে হয়। স্থানীয় মিস্ত্রিরা নানা ঝামেলায় পড়েন। পোহাতে হয় নানা দুর্ভোগ। রাস্তায় গাড়ি নিয়ে দু-একদিন পড়ে থাকতে হয়। তাদের এ সীমাহীন কষ্টের কথা চিন্তা করে তারেক ভাবলেন কীভাবে বিদ্যুৎ ছাড়া যানবাহনে হাওয়া দেওয়ার যন্ত্র উদ্ভাবন করা যায়।

প্রথমে ২০১৫ সালে বিদ্যুতবিহীন ও দামে সস্তা শ্যালো মেশিনের পুরানো সহজলভ্য কাঁচামাল দিয়ে পরীক্ষামূলকভাবে যানবাহনে হাওয়া দেওয়ার যন্ত্র উদ্ভাবন করেন তিনি। যন্ত্রটির নাম দেন কমপ্রেসার। প্রেসার দিয়ে টিউবওয়েলের মতো চাপ দিতে হয় বলে তিনি এ যন্ত্রের নাম দেন কমপ্রেসার। প্রথম যন্ত্রটি উদ্ভাবনের পর পাশের ঘাটাইল উপজেলার গারোবাজার এলাকার স্থানীয় মেকার পাঁচ হাজার টাকায় যন্ত্রটি কিনে নেন। তিনি বিদ্যুৎ ছাড়াই যে কোন সময় যে কোন গাড়ির হাওয়া দিতে পারেন। তার দেখাদেখি মোটেরবাজার এলাকার এক মেকার যন্ত্রটি ক্রয়ের জন্য তারেকের সাথে যোগাযোগ করেন। তারেক আরেকটু শতর্কতার সাথে যন্ত্রটি তৈরি করে একইমূল্যে বিক্রয় করেন। ধীরে ধীরে বাড়তে থাকে প্রচার। স্থানীয় মেকাররা একে অপরের সাথে যোগাযোগ করে। কোথায় পাওয়া যায় এ যন্ত্রটি। তারা সন্ধান দিতে থাকেন তারেকের। এভাবে যন্ত্র উদ্ভাবন সফল হয়। বাজারজাত শুরু হয় তার কমপ্রেসার যন্ত্র। নিত্য নতুন ধারণা নিয়ে তারেক ভেবেচিন্তে তৈরি করতে থাকেন যন্ত্রটি। এভাবে প্রচার ও প্রসার ঘটে।

তারেক জানান, যন্ত্রটি তৈরি করতে যতসামান্য উপকরণ প্রয়োজন হয়। পুরনো ফেলে দেওয়া শ্যালো মেশিনের যন্ত্রাংশই হলো এ যন্ত্রের উপকরণ। বাড়তি কোন ঝামেলা নেই। সহজেই যে কেউ হাওয়া দিতে পারে। হাতলে চাপলেই প্রেসার হয়। এ হাওয়া দেওয়া যন্ত্রের যে সব উপকরণ বা অংশ থাকে তা হলো সাধারণ টিউবওয়েলের মতো হাতল, যা রিক্সার পুরানো এক্সেল দ্বারা তৈরি। কানেকটর একটি, যা পুরানো পাওয়ার টিলারের ফেলে দেওয়া শেভ। স্ট্যান্ড একটি, যা পাওয়ার টিলারের পুরানো শেভ দ্বারা তৈরি। প্লেট দুইটি, যা জাহাজের পুরানো ইস্পাত বা মোটা লোহার ইস্পাত। পুরানা শ্যালো মেশিনের পিস্টন একটি, রিং চারটি, শ্যালো মেশিনের পুরানো রিং যা ফেলে দেওয়া ভাঙ্গারি দোকান থেকে ক্রয় করা যায়। এছাড়া কয়েকটি নাট-বল্টু, দুটি নতুন বা পুরানো বেয়ারিং ও একটি কানেকশন চিকন পাইপ হলেই তৈরি করা যায় এ যন্ত্র।

তিনি জানালেন, যন্ত্রটি দেখতে ছোট টিউবওয়েলের মতো। নিচে ছিদ্র করা। চাপলে ছিদ্র দিয়ে হাওয়া ঢুকে পিস্টন ভর্তি হয়। হাতল নিচে নামলে হাওয়া বের হয়। এভাবেই কমপ্রেসারটি তৈরি করা। কমপ্রেসারটি তৈরি করতে সময় লাগে দুই দিন। দাম নির্ধারণ করা হয়েছে পাঁচ হাজার টাকা।

তারেক আরো জানান, তিনি এক সময় শ্যালো মেশিনের মেকার ছিলেন। সে থেকেই পাম্প টিউবওয়েল তৈরি করেন। এবার তৈরি করলেন হাওয়া দেওয়ার যন্ত্র কমপ্রেসার। এরপর জ্বালানী সাশ্রয়ী জেনারেটর উদ্ভাবন করবেন বলে তিনি জানালেন।

তারেকের জন্ম টাঙ্গাইলের মধুপুর উপজেলার ভবানীটেকী গ্রামে। তার বাবার নাম আব্দুস সামাদ, মাতার নাম জহুরা বেগম। ৭ ভাই বোনের মধ্যে তারেক ষষ্ঠ। তার ভাইয়েরা বিভিন্ন কর্মে নিয়োজিত। তারেকের প্রাইমারির সীমানা পেরিয়ে যাওয়ার সৌভাগ্য হয়নি। শিক্ষিত না হলেও মেধা মননে কারিগরি জ্ঞানে অনন্য। তারেক এসব যন্ত্র তৈরি করার জন্য ভবানীটেকি বাজারে গড়ে তুলেছেন ছোটখাট কারখানা।

নিজস্ব জমিতে গড়ে তোলা কারখানার নাম দিয়েছেন হাছান ইঞ্জিনিয়ারিং ওয়ার্কসপ। এখানে সে কাক ডাকা ভোর থেকে রাত ৯/১০ টা পর্যন্ত এসব উদ্ভাবনী কাজ করেন। তার বড় ছেলে হাছান স্থানীয় ভবানীটেকী উচ্চ বিদ্যালয়ে দশম শ্রেণিতে পড়ে। ভবিষ্যতে তার ছেলেকে শিক্ষিত করে ইঞ্জিনিয়ার বানাবেন এটাই তার স্বপ্ন। ছোট ছেলের বয়স দু’বছর। তিনি আরো জানান, সকালে ঘুম থেকে উঠে নিজের তৈরি টিউবওয়েলের পানি গৃহস্থালীর কাজে যখন ব্যবহার করেন তখন তার মনটা ভরে উঠে। এক সময় শ্যালো মেকার হিসেবে তাকে কেউ মূল্যায়ন করত না। এখন তাকে সবাই সম্মানের চোখে দেখে।

তার টিউবওয়েল দেখে অনেকেই নকল করে বানানোর চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। বাংলাদেশে প্রথম তারেক এ পাম্প টিউবওয়েল এবং হাওয়া দেওয়ার এ যন্ত্র কমপ্রেসার উদ্ভাবন করেন। অর্থ সংকট ও পৃষ্ঠপোষকতার অভাবে তিনি এগিয়ে যেতে পারছেন না। তার আশা সরকারি ও বেসরকারি পৃষ্ঠপোষকতা বা সহযোগিতা পেলে বাতাস দিয়ে বিদ্যুৎ তৈরি ও ঘন্টায় ২শ ৫০ এমএল জ্বালানী দিয়ে জেনারেটর উদ্ভাবন করে তিনি এগিয়ে যেতে চান।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.