বঙ্গবন্ধুর ঘনিষ্ঠ সহচর সাবেক সাংসদ আব্দুর রহিমের ইন্তেকাল

রতন সিং, দিনাজপুর: বাংলাদেশের সংবিধান প্রণয়ন কমিটির সদস্য, মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম সংগঠক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ঘনিষ্ঠ সহচর ও দিনাজপুর সদর আসনের সাবেক সাংসদ এ্যাড. আলহাজ্ব এম. আব্দুর রহিম রোববার বেলা ১১টা ২০ মিনিটে ঢাকার বারডেম হাসপাতালে ইন্তেকাল করেছেন (ইন্নালিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহি রাজিউন)। মৃত্যুকালে তাঁর বয়স হয়েছিল ৮৯ বছর। তিনি স্ত্রী, দুই ছেলে, চার মেয়েসহ অনেক আত্মীয়-স্বজন গুণগ্রাহী রেখে গেছেন।

Dinajpur M Abdur Rahim Photo
বঙ্গবন্ধুর ঘনিষ্ঠ সহচর এম আব্দুর রহিম।

৩ আগষ্ট রাতে বার্ধক্যজনিক কারণে অসুস্থ হয়ে পড়লে তাকে দিনাজপুর জিয়া হার্ট ফাউন্ডেশন অ্যান্ড রিসার্চ সেন্টার হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। সেখানে তার অবস্থা কিছুটা উন্নতি হলে গত ৯ আগষ্ট বিকেল ৪টায় এয়ার এ্যাম্বুলেন্সযোগে দিনাজপুর থেকে ঢাকায় চিকিৎসার জন্য নিয়ে যাওয়া হয়।

তাঁর ছোট ছেলে জাতীয় সংসদের হুইপ ইকবালুর রহিম এমপি জানান, রোববার বাদ আছর জাতীয় সংসদের দক্ষিণ প্লাজায় মরহুমের নামাজে জানাজা অনুষ্ঠিত হবে। এরপর তাঁর কফিনে শ্রদ্ধা নিবেদনের জন্য জাতীয় সংসদ ভবনে রাখা হবে। ঢাকায় আনুষ্ঠানিকতা শেষে তাঁর মরদেহ দিনাজপুর শহরের নিজ বাসভবন মুন্সিপাড়ায় নিয়ে আসা হবে। আজ সোমবার দিনাজপুর গোর-এ-শহীদ বড়ময়দানে তাঁর দ্বিতীয় নামাজে জানাজা সকাল ১১টায় অনুষ্ঠিত হবে। এরপর তাঁকে সোমবার বাদ আছর দিনাজপুর সদর উপজেলার জালালপুর গ্রামে নিজ বাড়িতে পারিবারিক কবরস্থানে দাফন করা হবে।

সোমবার সকাল ১০টায় দিনাজপুর কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে সর্বস্তরের মানুষের শ্রদ্ধা নিবেদনের জন্য তাঁর মরদেহ রাখা হবে।

তাঁর বড় ছেলে এম. ইনায়েতুর রহিম বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্ট হাইকোর্ট বিভাগের বিচারপতি। ছোট ছেলে এম. ইকবালুর রহিম দিনাজপুর সদর আসন থেকে পর পর দুই বার জাতীয় সংসদের সদস্য নির্বাচিত হন। তিনি জাতীয় সংসদের হুইপ হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন।

তাঁর চার মেয়ের মধ্যে দুই মেয়ে ডাঃ নাসিমা বেগম ও ডাঃ নাদিরা বেগম ঢাকায় চিকিৎসা পেশায় নিয়োজিত রয়েছেন। অপর দুই মেয়ে নাফিসা বেগম ও নাজিলা বেগম গৃহবধূ।

মরহুম এম. আব্দুর রহিম ব্যক্তিগত জীবনে একজন সৎ, নির্ভীক ও প্রভাবশালী রাজনীতিবিদ এবং সমাজসেবক ছিলেন। তিনি পেশাগত জীবনে একজন আইনজীবী ছিলেন।

এম. আব্দুর রহিম ১৯২৭ সালের ২১ নভেম্বর দিনাজপুর সদর উপজেলার ৮নং শংকরপুর ইউনিয়নের জালালপুর গ্রামের এক বনেদি মুসলিম পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। ছাত্রাবস্থায় রাজশাহী কলেজে ভাষা আন্দোলনের কর্মসূচিতে সংযুক্ত ছিলেন। মুসলিমলীগ সরকারের হক-ভাসানী-সোহরাওয়ার্দীর যুক্তফ্রন্টের একজন কর্মী হিসেবে হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীর সঙ্গে ১৯৫৪ সালের নির্বাচনী প্রচারাভিযানে অংশ নেন। জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানসহ অন্যান্যদের বিরুদ্ধে দায়েরকৃত ঐতিহাসিক আগরতলা মামলার তিনি লিগ্যাল এইড কমিটির একজন সদস্য ছিলেন। আওয়ামী লীগের প্রার্থী হিসেবে ১৯৭০ সালে প্রাদেশিক পরিষদের সদস্য নির্বাচিত হয়ে ১৯৭১ এর মহান স্বাধীনতা যুদ্ধে বৃহত্তর দিনাজপুর আঞ্চলের মুক্তিযুদ্ধের সংগঠক হিসেবে অক্লান্ত পরিশ্রম করেন। ১৯৭১ সালের ১৭ এপ্রিল মুজিবনগর সরকার গঠন হলে সারা দেশকে যুদ্ধ পরিচালনার জন্য ১১টি বেসামরিক জোনে ভাগ করা হয়। এম. আব্দুর রহিম ছিলেন পশ্চিম জোনের জোনাল চেয়ারম্যান। দেশ স্বাধীন হওয়ার পর তিনি ১৯৭১ সালের ১৮ ডিসেম্বর দিনাজপুর গোর-এ-শহীদ বড় ময়দানে আনুষ্ঠানিকভাবে প্রথম স্বাধীন বাংলাদেশের পতাকা উত্তোলন করেন।

১৯৭২ সালের ১১ এপ্রিল স্বাধীন বাংলাদেশের সংবিধান প্রণয়নের জন্য গঠিত কমিটির ৩৪ জন সদস্যের মধ্যে তিনি একজন সদস্য ছিলেন। তিনি ১৯৯১ সালে দিনাজপুর সদর আসন থেকে জাতীয় সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন। এর আগে ১৯৭০ সালের নির্বাচনে আওয়ামী লীগের প্রার্থী হিাসেবে বৃহত্তর দিনাজপুর থেকে প্রাদেশিক পরিষদের সদস্য নির্বাচিত হয়েছিলেন।  তিনি দীর্ঘদিন দিনাজপুর জেলা আওয়ামী লীগ ও দিনাজপুর জেলা আইনজীবী সমিতির সভাপতির দায়িত্ব পালন করেন।

আব্দুর রহিমের মৃত্যুতে রাষ্ট্রপতি আবদুল হামিদ, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা, স্পিকার শিরীন শারমিন চৌধুরী, বিরোধীদলীয় নেতা রওশন এরশাদ শোক প্রকাশ করে বিবৃতি দিয়েছেন। এ ছাড়া  দিনাজপুর ৪ আসন (চিরিরবন্দর-খানসামা) নির্বাচিত সাংসদ ও পররাষ্ট্রমন্ত্রী এএইচ মাহমুদ আলী, বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় সাংগঠনিক সম্পাদক ও দিনাজপুর ২ আসনের সাংসদ খালিদ মাহমুদ চৌধুরী, দিনাজপুর জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি এবং প্রাথমিক ও গণশিক্ষামন্ত্রী এ্যাডঃ মোস্তাফিজুর রহমান এমপি, সাধারণ সম্পাদক ও জেলা পরিষদের প্রশাসক আজিজুল ইমাম চৌধুরী, দিনাজপুর ১ আসনের সাংসদ মনোরঞ্জনশীল গোপাল, দিনাজপুর ৬ আসনের সাংসদ শিবলী সাদিক, দিনাজপুর শহর আওয়ামী লীগ, সদর উপজেলা আওয়ামী লীগ, অঙ্গসংগঠন, দিনাজপুর চেম্বার অব কমার্স এন্ড ইন্ডাষ্ট্রি, দিনাজপুর প্রেসক্লাব, দিনাজপুর মোটরপরিবহন মালিক সমিতি, দিনাজপুর মোটর পরিবহন শ্রমিক ইউনিয়ন, দিনাজপুর জেলা আইনজীবী সমিতিসহ বিভিন্ন রাজনৈতিক, সামাজিক ও পেশাজীবী সংগঠনের পক্ষ থেকে তাঁর মৃত্যুতে শোক প্রকাশ করা হয়েছে।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.