রতন সিং, দিনাজপুর: দিনাজপুরে প্রত্নতত্ব খননে একাদশ থেকে দ্বাদশ শতকের একটি বিষ্ণু মন্দিরের সন্ধান পাওয়া গেছে। এই মন্দিরটি নবরথ বিশিষ্ট, যা বাংলাদেশে আবিস্কৃত মন্দিরের মধ্যে প্রথম। শুধু তাই নয়, এই প্রত্নতত্ব খননে দুষ্প্রাপ্য মোহিনীর মূর্তি পাওয়া গেছে। বিশেষজ্ঞদের মতে এটি ভগবান বিষ্ণুর একমাত্র নারী অবতার। আর এই মূর্তিটি পূর্ব ভারতে পাওয়া প্রথম মূর্তি বলে জানিয়েছেন বিশেষজ্ঞরা। তাদের মতে, ভাগবত ও পুরানে ভগবান বিষ্ণুর ২২টি অবতারের কথা বলা হয়েছে, মোহিনী তাদের মধ্যে অন্যতম এবং একমাত্র নারীরূপ। ভারত উপমহাদেশের পূর্বাংশে এটি প্রথম প্রস্তর নির্মিত মোহিনীর প্রতিমা।
২০১৪ সালে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের মঞ্জুরী কমিশনের অর্থায়নে দিনাজপুরে প্রত্নতাত্বিক জরিপ চালায় বিশ্ববিদ্যালয়ের একটি দল। এই জরিপের অংশ হিসেবে চলতি বছরের এপ্রিল মাসে দিনাজপুরের কাহারোল উপজেলার ডাবোর ইউনিয়নের মাধবগাঁও এলাকায় প্রত্নতত্ব খননের কার্যক্রম শুরু করে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রত্নতত্ব বিভাগ। মাত্র দুই সপ্তাহের খননেই এখানে পুরাতন স্থাপত্যশৈলীর মন্দিরটি রয়েছে বলে নিশ্চিত হয় দলটি।
এরপর সংস্কৃতি মন্ত্রণালয় ও বাংলাদেশ বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরী কমিশনের অর্থায়নে টানা তিন মাসের বেশি সময় ধরে খনন কার্যক্রম পরিচালনার মাধ্যমে দলটির সদস্যরা এখানে যে স্থাপনাটি উন্মোচিত করেছেন তা বিষ্ণুমন্দির এবং সেটি একাদশ থেকে দ্বাদশ শতকের মধ্যকার পূর্ব ভারতীয় হিন্দু মন্দিরের গঠনের সাথে মাসঞ্জস্যপূর্ণ। আদিমধ্যযুগের পূর্বভারতীয় মন্দির স্থাপত্যের সাথেও এই মন্দিরের সামঞ্জস্য রয়েছে। বিশেষ করে উড়িষ্যার কলিঙ্গ স্থাপত্যশৈলী যেটি একাদশ এবং দ্বাদশ শতকে বিকশিত হয়েছিল সেই স্থাপত্যশৈলীর সাথে এর মিল রয়েছে। এটি দু’টি অংশে বিভক্ত- একটি গর্ভগৃহ যেখানে পূজা বা উপাসনা করা হতো, এটি বিশেষ কিছু অভিক্ষেপ দিয়ে চিহ্নিত। এই অভিক্ষেপগুলোকে স্থাপনা শিল্পের বা শিল্পশাস্ত্রর ভাষা অনুযায়ী রথ বলা হয়। এখানে মোট ১১টি রথ রয়েছে, যার মধ্যে দু’টি উপরথ।
পাশাপাশি কিছু আলামতের ভিত্তিতে এটি নবরথ বিশিষ্ট একটি মন্দির বলে নিশ্চিত করা হয়েছে। খননকালে এখানে প্রস্তর প্রতিমার ভগ্নাংশ হিসেবে হিন্দু দেবতা বিষ্ণুর সমপদাস্থানক ভঙ্গিতে দন্ডায়মান প্রতিমার হাতে থাকা শঙ্খ, চক্র, গদা, বিষ্ণুপ্রতিমার বনমালা শোভিত পায়ের ভগ্নাংশ এবং একটি দেবী প্রতিমার ভগ্নাংশ পাওয়া গেছে।
এই খনন কার্যক্রমে বগুড়ার মহাস্থানগড় থেকে আসা অভিজ্ঞ ১৩ জন শ্রমিকের সাথে আরও ২৬ জন স্থানীয় শ্রমিক কাজ করছেন। খনন দলে রয়েছে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রত্নতত্ব বিভাগের ১০ জন শিক্ষার্থী। তারা প্রাচীন এই খননকাজে অংশগ্রহণ করে স্থাপত্যের নকশা আঁকছেন। পরবর্তীতে কেউ গবেষণা করতে চাইলে এই নকশার মাধ্যমে করতে পারবে।
এলাকার লোকজন জানায়, এই উঁচু ঢিবিটি বুরুজ বলে পরিচত ছিল, গাছ-গাছালি দিয়ে ঢাকা ছিল এই ঢিবিটি। তবে অনেকেই শুনেছেন এখানে পূর্বে মন্দির ছিল। এই মন্দিটিকে সংরক্ষণের দাবি জানিয়েছেন এলাকাবাসী।
ওই এলাকার অমৃত রায় জানান, এতদিন তারা এটিকে ঢিবি বলেই জানতো। কিন্তু এর ভিতরে যে এত সুন্দর একটি মন্দির রয়েছে তা তারা কোনভাবেই অনুমান করতে পারেনি। তিনি জানান, অনেকেই এখানে ছাগল-গরু বাধতো।
এলাকার স্বপন চন্দ্র রায় জানান, যেহেতু এটি ভগবান বিষ্ণুর মন্দির হিসেবে আবিস্কৃত হয়েছে তাই এটিকে এভাবেই রেখে দেয়ার দাবি এলাকাবাসীর, যাতে করে তারা এখানে পূজা অর্চনা করতে পারেন। একই দাবি জানিয়ে এলাকার ভবেষ চন্দ্র জানান, যদি এটি এভাবে রেখে দেয়া যায় তাহলে পূর্বের মন্দির কি রকমের ছিল তা জানতে তাদের এলাকায় অনেকেই আসবেন সুন্দর এই মন্দিরটি দেখতে।
জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের সহকারী অধ্যাপক সীমা হক জানান, আবিস্কৃত মন্দিরটির প্রবেশদ্বার পূর্ব দিকে। প্রাচীন এই মন্দিরের নকশা ও স্থাপত্যশৈলী দেখে সহজেই অনুমান করা যায় এক সময়ে এই অঞ্চল উন্নত ও সমৃদ্ধ ছিল। কিন্তু কালের বিবর্তণে এই অঞ্চল অবহেলিত হয়ে পড়ে।
খনন দলের প্রধান জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের সহযোগী অধ্যাপক ড. স্বাধীন সেন জানান, স্থাপনাটির স্থাপত্যিক বৈশিষ্ট্য আদিমধ্যযুগ বা খ্রীষ্ট্রিয় ষষ্ট শতক থেকে ত্রয়োদশ শতকের পূর্বভারতীয় স্থাপত্যশৈলীর সাথে সামঞ্জস্য রয়েছে। কিছু আলামতের ভিত্তিতে তারা নিশ্চিত হয়েছেন এটি একাদশ বা দ্বাদশ শতকের নবরথ বিশিষ্ট একটি বিষ্ণু মন্দির। মন্দিরটি দু’টি অংশে বিভক্ত। পশ্চিম দিকে ১২/১২ মিটার নিরেট প্লাটফর্মের ছোট কক্ষ রয়েছে। যেখানে প্রতিমার উপাসনা হতো। মন্দিরের বর্হিগতের অভিক্ষেপের সংখ্যা ৯টি। তাই এটিকে নবরথ মন্দির বলা হচ্ছে। তিনি জানান, এটি বাংলাদেশে আবিস্কৃত প্রথম নবরথ মন্দির। এর আগে দিনাজপুরের নবাবগঞ্জে একটি পঞ্চরথ মন্দির আবিস্কৃত হয়েছিল।
অধ্যাপক ড. স্বাধীন জানান, মন্দিরটির স্থাপনারীতি ও গঠনশৈলী নিয়ে ভারতের কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক অধ্যাপক ও ভারতীয় স্থাপত্যের বিশেষজ্ঞ দীপক সঞ্জন দাসের সাথে আলাপ হলে তিনি জানিয়েছেন মন্দিরটির উপরিকাঠামো পশ্চিম বাংলার বাকুড়া জেলার সিদ্ধেশ্বরী মন্দিরের সাথে সামঞ্জস্য রয়েছে। পাশাপাশি খনন কাজের শেষ দিকে ঢিবির পূর্বাংশ থেকে একটি দুস্প্রাপ্য প্রতিমার ভগাংশ পাওয়া গেছে। প্রতিমাটি সম্পর্কে দক্ষিণ এশিয়ার প্রখ্যাত প্রতিমালক্ষনবিদ ও প্রাচীন শিল্পকলার ইতিহাসবিদ ক্লদিন বুদজে পিক্রোর সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তিনি প্রতিমাটিকে বিষ্ণুর নারী অবতার মোহিনী হিসেবে সনাক্ত করেছেন। ক্লদিন জানিয়েছেন, প্রতিমাটি ভারত উপমহাদেশের পূর্বাংশে এই প্রথম প্রস্তরনির্মিত বিষ্ণুর নারী অবতার মোহিনীর মূর্তি। নবরথ বিষ্ণু মন্দির ও দুষ্প্রাপ্য মোহিনীর প্রতিমা পাওয়ায় এই অঞ্চলের ইতিহাস, ইতিহাসের স্বাক্ষ ও ঐতিহ্য সম্পর্কে নতুন ভাবনার মোড় নিয়েছে।
তিনি জানান, যারা খনন কাজ করতে গেছে তাদের কোন সমস্যা হয়নি। বরং এলাকাবাসীর সাথে এক আত্মীয়তার বন্ধনে আবদ্ধ হয়েছেন। এখানে যেসব নিদর্শন পাওয়া গেছে তা তাদের নিকটই আছে। গবেষণা কার্যক্রম চালানোর জন্য সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়ের সাথে চুক্তি মোতাবেক তারা এইসব নিদর্শন এক বছর পর্যন্ত গবেষণা কাজে ব্যবহারের জন্য নিজেদের কাছে রাখতে পারবেন। পরে সেগুলো প্রত্নতত্ব অধিদপ্তরে জমা দিতে হবে। অধ্যাপক সেন জানান, নিয়ম অনুযায়ী প্রত্নতত্ব খননের পর ছবি তোলা ও ড্রয়িং কাজ নথিভুক্ত করার পর সংরক্ষণের জন্য স্থাপত্য কাঠামোটি পুনরায় মাটি দিয়ে ঢেকে দিতে হয়। তাই এই স্থানটিও কয়েকদিনের মধ্যেই মাটি দিয়ে ঢেকে দেওয়া হবে। স্থানীয়দের দাবি রয়েছে এটি যেন উন্মুক্ত করে দেওয়া হয়, কিন্তু সেটি করতে হলে প্রত্নতত্ব অধিদপ্তরের অনুমোদন ও সংরক্ষণ করা লাগবে। সংরক্ষণ না করেই এভাবে রেখে দিলে কিছুদিনের মধ্যে এটি নষ্ট হয়ে যাবে। বিষয়টি এলাকার লোকজনকে বোঝানো হয়েছে এবং প্রায় ৬শ’ গ্রামবাসীর স্বাক্ষর নেওয়া হয়েছে স্থানটি সংরক্ষণ ও উন্মুক্ত করে দেওয়ার জন্য। স্বাক্ষরসহ আবেদন স্থানীয় সংসদ সদস্য, ইউএনও, প্রত্নতত্ব অধিদপ্তর, সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়ের সচিবসহ বিভিন্ন দপ্তরে প্রেরণ করা হয়েছে। সেখান থেকে সংরক্ষণের নির্দেশ আসলেই সংরক্ষণের পর তা জনগণের জন্য উন্মুক্ত করে দেওয়া সম্ভব হবে।
তিনি জানান, এসব খনন কাজের যাবতীয় ব্যয়ভার সংস্কৃতি মন্ত্রণালয় করে থাকে। কিছুদিনের মধ্যেই দিনাজপুরের বিরল উপজেলার একটি স্থানে খনন কার্যক্রম শুরু করা হবে। তিনি আশাবাদী যেভাবে সরকারি সহযোগিতা তিনি পান সেইভাবেই সহযোগিতা পেয়ে থাকবেন, আর এর মাধ্যমে এই অঞ্চলের ইতিহাস, ঐতিহ্যের স্বাক্ষী ও সংস্কৃতি সম্পর্কে বিশদ জানা সম্ভব হবে।