জীবনের গল্পগুলো নতুন করে লিখছেন দড়িপাড়ার নারীরা

হাকিম বাবুল, শেরপুর: অভাব-অনটনের মধ্য দিয়ে বেড়ে উঠেছেন সমলা বেগম। দরিদ্র বাবা-মায়ের এই মেয়েটির বিয়ে হয় শৈশবে, দিনমজুর হায়দার আলী সঙ্গে। স্বামীর সংসারেও ভীষণ দারিদ্র্য। কয়েক বছরের মধ্যে সংসারে মানুষ বাড়ে, এক কন্যা এবং দুই ছেলের জন্ম দেয় এ দম্পতি। পাঁচজনের সংসারের জীবনে অভাব আরো জেঁকে বসে।

আরো বিপর্যয় অপেক্ষা করছিল তাদের জন্য। স্বামী অসুস্থ হয়ে পড়েন। সমলা অন্যের বাড়িতে কাজ করে কোনোমতে সংসার টিকিয়ে রাখছিলেন।

২০১৫ সালে সমলাদের গ্রামে একটি বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থা গরিব নারীদের উপার্জনমূলক কাজের সঙ্গে যুক্ত করতে কাজ শুরু করে। এই কর্মসূচিতে সমলার নামও অন্তর্ভুক্ত হয়। অন্য নারীদের সঙ্গে তিনি গরু মোটাতাজা করা ও হাসঁ-মুরগি পালনের ওপর চারদিনের প্রশিক্ষণ পান। প্রশিক্ষণের পর সংস্থাটি তাকে ১২ হাজার টাকা ঋণ প্রদান করে ।

সমলা ঋণের টাকায় একটি গরু কেনেন। পাশাপাশি সংস্থার পক্ষ থেকে সহায়ক ভাতা পান ৬ হাজার ৯৩০ টাকা এবং গরুর খাবার বাবদ পান ৬০০ টাকা। সংস্থাটি গরুর কৃমিনাশক ও অন্যান্য ওষুধ প্রদান করে।

ছয় মাস পর সমলা ৩২ হাজার টাকায় গরুটি বিক্রি করেন। এর থেকে ঋণের টাকা শোধ করেন। এর পর আরেক দফা ১৫ হাজার টাকা ঋণ নিয়ে আরেকটি গরু পালেন। সেটি বিক্রি করেন সাড়ে ৩৪ হাজার টাকা। এখন তিনি একটি গরু, এগারটি মুরগি পালছেন। একটি রিকশাও কিনেছেন সমলা। সংসারের অভাব-অনটন অনেকটাই ঘুচিয়ে ফেলেছেন। তার মেয়েটির লেখাপড়ায় ছেদ পড়েছিল। এক বছরের বিরতি দিয়ে এবার তাকে এইচএসসিতে ভর্তি করিয়েছেন।

সমলা বেগম (৪৫) বলেন, আল্লায় আমারে খুব বালা রাখছে। আগে চাইয়া-মাইগ্গা খাইতাম, কোন সুময় খাইতাম, কোন সুময় পাইতাম না। আর অহন আল্লায় আমার দিন ফিরাইছে। ঋণের ট্যাহায় গরু পাইল্লা আমি অহন গরু-ইস্কার মালিক অইছি। অহন নিজের ইচ্ছামতো বালামুন্দ চাইড্ডা খাবার পাই। আল্লায় দিলে অহন আমার সংসারো অভাব খুব একটা টের পাইন্না।

সমলা বেগমের মতোই শেরপুর সদর উপজেলার কৃষ্ণপুর দড়িপাড়া গ্রামের হতদরিদ্র রওশন আরা, সাজেদা বেগম, রিপা বেগম, মর্জিনা বেগম, দুলালী বেগমও নতুন করে লিখছেন জীবনের গল্প। মাত্র দুই-তিন বছরের ব্যবধানে এসব উদ্যমী নারীরা গরু-ছাগল-ভেড়া, হাঁস-মুরগি পালন এবং ক্ষুদ্র নার্সারি প্রতিষ্ঠা করে স্বাবলম্বী হয়েছেন। একসময় যারা খেয়ে না খেয়ে দিন কাটাতেন, আজ তারা তিনবেলা পেটপুরে খেতে পারছেন। শনের ঘরকে বানিয়েছেন টিনের ঘর। তাদের সন্তানরা নিয়মিত স্কুলে যাচ্ছে।

sherpur-ultrapoor-women

শেরপুরের জেলা প্রশাসক ডা. এ এম পারভেজ রহিম এসব উদ্যোগী নারীদের বাড়িতে যান, তাদের সঙ্গে বৈঠক করেন, তাদের সঙ্গে কথা বলেন। জেলা প্রশাসকের সঙ্গে ছিলেন প্রাণিসম্পদ কর্মকর্তা ডা. মো. আব্দুল মান্নান, সিভিল সার্জন অফিসের মেডিকেল অফিসার ডা. নীলাদ্রি হোড়, ইউপি চেয়ারমান মো. সেলিম মিয়া, ব্র্যাক কর্মকর্তা আতাউর রহমান। গণমাধ্যমকর্মীরাও এ সময় উপস্থিত ছিলেন। আন্তর্জাতিক দারিদ্র্য বিমোচন দিবস উপলক্ষে সপ্তাহব্যাপী কার্যক্রমের অংশ হিসেবে বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থা ব্র্যাকের শেরপুর জেলা কার্যালয় এ মাঠ পরিদর্শনের আয়োজন করে।

রওশন আরা নামের এক নারী জানান, তিনি ব্র্যাক থেকে চারটি ভেড়া পেয়েছিলেন। ছয় মাস পর পর ভেড়া বাচ্চা দেয়। তিনি ১০টি ভেড়া ২৫ হাজার টাকায়  বিক্রি করেছেন। এরপর তিনি ১৫ হাজার টাকা দিয়ে একটি বকনা বাছুর কেনেন এবং ছয় হাজার টাকায় একটি পুরাতন রিকশা কেনেন। বাকি চার হাজার টাকা সংসারের জন্য খরচ করেন। এখন তিনি চারটি ভেড়া, একটি বকনা বাছুর পালছেন। তার স্বামী প্রতিবন্ধী। তবে এখন সংসার চালাতে খুব একটা অসুবিধা হচ্ছে না বলে জানান তনি ।

আরেক নারী সাজেদা বেগমও চারটি ভেড়া লালন-পালন করেন। আটটি ভেড়ার বাচ্চা ১৮ হাজার টাকায় বিক্রি করেন তিনি। ওই টাকা থেকে ১৪ হাজার টাকায় তিনি একটি গরু কেনেন। বাকি ৪ হাজার টাকা দিয়ে ফেরি করে কাপড়ের ব্যবসা করছেন।

জেলা প্রশাসকসহ অতিথিরা এসব হতদরিদ্র নারীর জীবন সংগ্রাম ও তাদের ইতিবাচক পরিবর্তনের কথা শুনে তাদের প্রশংসা করেন। পরে জেলা প্রশাসক কয়েকজন গ্রামীণ নারীর মাঝে স্বাস্থ্যসম্মত পায়খানা, ঢেউটিন ও নগদ অর্থ বিতরণ করেন।

ব্র্যাক জেলা প্রতিনিধি মো. আতাউর রহমান জানান, ২০১৫ সালে ব্র্যাক শেরপুরের চার উপজেলায় ৩ হাজার ১১২ জন অতিদরিদ্র গ্রামীণ নারীর জীবনমান উন্নয়নে কাজ করছে। এবছর আরো ২ হাজার ১৪৪ জন অতিদরিদ্র গ্রামীণ নারী এ কর্মসূচির সঙ্গে যুক্ত হয়েছেন। তিনি জানান, অতিদরিদ্র নারীদের আয়মূলক উদ্যোগে সম্পৃক্ত করা এ কর্মসূচির উদ্দেশ্য। এজন্য তাদের কর্মমুখী প্রশিক্ষণ প্রদান, বিনামূল্যে সম্পদ হস্তান্তর, সহায়ক ভাতা, স্বাস্থ্য ও সামাজিক সেবা ইত্যাদিও সঙ্গে প্রয়োজনীয় সম্পদ ক্রয়ের জন্য সহজ শর্তে ঋণ প্রদান করা হয়।

জেলা প্রশাসক ডা. এ এম পারভেজ রহিম বলেন, সরকার ও এনজিও একত্রে কাজ করছে বলেই দেশ দারিদ্র্যমুক্ত হচ্ছে। সরকারের পাশাপাশি বিভিন্ন এনজিও বিশেষ করে ব্র্যাক শেরপুর জেলায় অনেক ভালো কাজ করছে, দারিদ্র্য নিরসনেও ভুমিকা রাখছে। হতদরিদ্র নারীদের জীবন ও জীবিকা উন্ন্য়নে গ্রামীন নার্সারী, খামার, হাঁস-মুরগী পালন করার কাজে সম্পদ বিতরণসহ স্বাস্থ্য সেবা, ল্যাট্রিন বিতরণ করছে। এতে দারিদ্র্যের হার আগের তুলনায় অনেক কমেছে।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.