১৬টি মুখোমুখি ও খন্ডযুদ্ধের মধ্য দিয়ে ৭ ডিসেম্বর মুক্ত হয় সাতক্ষীরা

আমিনা বিলকিস ময়না, সাতক্ষীরা: ৭ ডিসেম্বর সাতক্ষীরা মুক্ত দিবস। ১৯৭১ সালের এই দিনে সাতক্ষীরার দামাল ছেলেরা থ্রি নট থ্রি আর এসএলআরের ফাঁকা গুলি ছুড়তে ছুড়তে সাতক্ষীরা শহরে প্রবেশ করে। ওড়ানো হয় স্বাধীন বাংলার পতাকা। সন্তান হারানোর বেদনা ভুলে সেদিন মুক্তিযোদ্ধাদের সাথে সাথে রাস্তায় নেমে আসে মুক্তিপাগল জনতা। নয় মাস রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের মধ্য দিয়ে সেদিনের সাহসী সন্তানরা বুকের তাজা রক্ত ঢেলে দিয়ে স্বাধীনতার পতাকা উড়িয়েছিল। ১৯৭১ সালের এই দিনে হানাদার বাহিনীর হাত থেকে মুক্তি পায় সাতক্ষীরাবাসী। দিনটি ঘিরে বাংলাদেশ মুক্তিযোদ্ধা সংসদ সাতক্ষীরা জেলা ইউনিট কমান্ড র‌্যালি, আলোচনা সভাসহ বিভিন্ন কর্মসূচি গ্রহণ করেছে।

১৯৭১ সালের ২ মার্চ সাতক্ষীরা শহরে পাকিস্তান বিরোধী মিছিলে রাজাকাররা গুলি করে হত্যা করে শহীদ আব্দুর রাজ্জাককে। আর এখান থেকে শুরু হয় সাতক্ষীরার দামাল ছেলেদের মুক্তিযুদ্ধে অংশ নেয়া। মুক্তিযুদ্ধের খরচাদি বহনের জন্য সাতক্ষীরা ট্রেজারি হতে অস্ত্র লুট আর ন্যাশনাল ব্যাংক হতে অলংকার টাকা পয়সা লুটের মধ্য দিয়ে শুরু মুক্তির সংগ্রাম।  ৮ম ও ৯ম সেক্টরের অধীনে ভারতের বিভিন্ন এলাকায় ট্রেনিং শেষে ২৯ এপ্রিল সাতক্ষীরার ভোমরা সীমান্তে প্রথম সম্মুখ যুদ্ধ শুরু হয় । এ সময় পাক সেনাদের ২ শতাধিক সৈন্য নিহত হয়। ১৭ ঘন্টাব্যাপী এ যুদ্ধে শহীদ হন মাত্র ৩ জন মুক্তিযোদ্ধা। আহত হন আরো ২ জন মুক্তিযোদ্ধা। এরপর থেমে থেমে চলতে থাকে সাতক্ষীরার বিভিন্ন এলাকায় মুক্তিযোদ্ধাদের গুপ্ত হামলা। এসব যুদ্ধের মধ্যে ভোমরার যুদ্ধ, টাউন শ্রীপুর যুদ্ধ, বৈকারী যুদ্ধ, খানজিয়া যুদ্ধ ছিল উল্লেখযোগ্য।

এ সব যুদ্ধে শহীদ হন ৩৩ জন মুক্তিযোদ্ধা। লাইটের আলোয় অসুবিধা হওয়ায় ৩০ নভেম্বর টাইম বোমা দিয়ে শহরের কেন্দ্রবিন্দুতে অবস্থিত পাওয়ার হাউস উড়িয়ে দিয়ে মুক্তিযোদ্ধারা ভীত সন্ত্রস্ত করে ফেলে পাক সেনাদের। রাতের আঁধারে বেড়ে যায় গুপ্তহামলা। পিছু হটতে শুরু করে পাক সেনারা। ৬ ডিসেম্বর রাতে মুক্তিযোদ্ধাদের হামলায় টিকতে না পেরে বাঁকাল, কদমতলা ও বেনেরপোতা ব্রীজ উড়িয়ে দিয়ে পাক বাহিনী সাতক্ষীরা থেকে পালিয়ে যায়। ৭ ডিসেম্বর জয়ের উন্মাদনায় জ্বলে ওঠে সাতক্ষীরার দামাল ছেলেরা।

দিনটির স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে বাংলাদেশ মুক্তিযোদ্ধা সংসদ সাতক্ষীরা জেলা ইউনিটের কমান্ডার মোশারফ হোসেন মশু জানান, দীর্ঘ ৯ মাস পর ১৯৭১ সালের ৬ ডিসেম্বর রাতেই এ অঞ্চল থেকে পালাতে শুরু করে পাকবাহিনী। পরদিন প্রত্যুষে রাজাকার আলবদর বাহিনী তাদের অস্ত্র ও মালামাল ফেলে প্রাণ বাঁচাতে স্ব স্ব ক্যাম্প থেকে পালাতে থাকে। ৭ ডিসেম্বর ভোর হতেই মুক্ত হওয়ার সুসংবাদ ছড়িয়ে পড়ে সবখানে।

এর আগে ১৯ ও ২০ নভেম্বর মুক্ত হয় শ্যামনগর ও কালিগঞ্জ। সেখান থেকে পিছু হটে পাক বাহিনী পারুলিয়া ব্রিজের কাছে প্রতিরোধ করেও ব্যর্থ হলে ব্রিগেডিয়ার হায়াত খানের নির্দেশে সেখান থেকে পিছু হটে।  তিনি বলেন, ১৬টি মুখোমুখি ও খন্ডযুদ্ধের মধ্য দিয়ে ৭ ডিসেম্বর মুক্ত হয় সাতক্ষীরা। লে. বেগ, ক্যাপ্টেন হুদা, লে. আরেফিন, মেজর জলিলের বাহিনী সম্মুখ সমরে ঝাঁপিয়ে পড়ে।  ৭ ডিসেম্বর ভোর বেলা মুক্তিযুদ্ধের সময় সংবাদ বাহক সাতক্ষীরা শহরের সুলতানপুরের ছাকুর কাছ থেকে সংবাদ পেয়ে মাটিয়াডাঙ্গা ক্যাম্প থেকে ১৭ জনের দল পুরাতন সাতক্ষীরা হয়ে সাতক্ষীরা কোর্ট চত্বরে পৌঁছায়। এ দলের নেতৃত্বে ছিলেন আব্দুল মহিত খান চৌধুরি দুলু। সেখানে জাতীয় পতাকা উত্তোলন করেন আবু নাছিম ময়না। এ দলে ছিলেন বদরুল, জাহিদ, সাদেক, আবু নাছিম ময়না, আব্দুর রশিদ, আজি, মাহবুব, গফুরসহ অনেকে।

মহান স্বাধীনতা যুদ্ধে সাতক্ষীরার যে সমস্ত তরুণ তাদের জীবন উৎসর্গ করেছেন তাদের মধ্যে শামছুজ্জোহা খান কাজল, নাজমুল আরেফিন খোকন, কমান্ডো সিরাজুল ইসলাম, নারায়ন চন্দ্র ধর, আবুল কালাম আজাদ, জোলযার, হারুনার রশিদ, আনছার আলী, মোজাম্মেল হক, আমিন উদ্দিন গাজী, রফিকুল ইসলাম, আজিজার রহমান, আবু বক্কর গাজী, হাফিজ উদ্দিন, এনামুল হক, আবুল কাশেম, সলিল কুমার, আব্দুল আজিজ, কমান্ডো আব্দুল কাদের, নায়েক সফি চৌধুরী অন্যতম।

এ সরকারের ওয়াদা মোতাবেক যুদ্ধাপরাধীদের বিচার করে চলেছে। বাকী যুদ্ধাধীদের বিচার সম্পন্ন করার দাবি জানিয়েছেন মুক্তিযোদ্ধারা। তারা স্মৃতিসৌধ থেকে অমুক্তিযোদ্ধাদের নাম বাদ দেয়া ও সাতক্ষীরার গণকবরগুলো সংরক্ষণেরও দাবি জানিয়েছেন।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.