সাতক্ষীরায় বিতর্কিত স্মৃতিফলকে কেউ শ্রদ্ধা জানাতে যায় না, স্মৃতিসৌধ না থাকায় ক্ষোভ

আমিনা বিলকিস ময়না, সাতক্ষীরা: সাতক্ষীরা জেলা সদরে স্মৃতিসৌধ না থাকায় সেভাবে শহীদদের স্মরণ করা হয় না। তা নিয়ে নতুন প্রজন্মের শিশু কিশোরদের মধ্যে বিরাজ করে হতাশা, দুঃখ ও ক্ষোভ। রাজধানীর সাভারে অবস্থিত জাতীয় স্মৃতিসৌধে শ্রদ্ধাঞ্জলি নিবেদনের দৃশ্য টিভিতে দেখে সাতক্ষীরা শহরের পলাশপোল গ্রামের দ্বিতীয় শ্রেণির ছাত্র অগ্র দুঃখ করছিল। সে কেন সাতক্ষীরার কোন স্মৃতিসৌধে শ্রদ্ধাঞ্জলি নিবেদন করতে পারছে না তা নিয়ে প্রশ্ন করে তার মায়ের কাছে। এমনিভাবে সাতক্ষীরা সরকারি উচ্চ বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী সাবীর, শহীদ রীমু সরণি এলাকার শিশু বারিদসহ সাতক্ষীরার বহু শিশু-কিশোর শহীদ স্মৃতিসৌধে শ্রদ্ধাঞ্জলি নিবেদন করতে না পারার ব্যাথায় ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া প্রকাশ করতে থাকেন। কিন্তু সাতক্ষীরার রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে এ ব্যাপারে নেই তেমন কোন ক্ষোভ-দুঃখ।

satkhira-folok-pic-1
সাতক্ষীরায় নির্মিত এই স্মৃতিফলকে রয়েছে রাজাকার ও অমুক্তিযোদ্ধাদের নাম।

জেলার কালেক্টরেট চত্বরে সারাদেশের সাথে নির্মাণ করা হয়েছিল মুক্তিযুদ্ধের একটি শহীদ স্মৃতিফলক। সেই ফলকে আছে রাজাকার ও অমুক্তিযোদ্ধাদের নাম। এ নিয়ে হয়েছে বহু আন্দোলন সংগ্রাম কিন্তু কেন আজও পর্যন্ত হয়নি মুক্তিযুদ্ধের শহীদ স্মৃতিসৌধ তা কেউ বলতে পারে নি।

সাতক্ষীরা সদর উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান ও জেলা আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক আসাদুজ্জামান বাবু বলেন, স্মৃতিসৌধ না থাকায় আজ বিজয় দিবসের দিনে শহীদ আব্দুর রাজ্জাকের সমাধীতে শ্রদ্ধা নিবেদন করে বিবেকের দায় মেটালাম। অনেক দিন থেকে শুনছি খুলনা রোডের মোড়ে শহীদ মুক্তিযোদ্ধা চত্বরে জেলা প্রশাসনের উদ্যোগে একটি স্মৃতিসৌধ নির্মাণ করা হবে। সে আওয়াজটাও গত তিন বছর যাবৎ আর শুনছি না।
ওয়ার্কার্স পার্টির জেলা সম্পাদক মন্ডলী সদস্য ও শহীদ পরিবারের সদস্য ফাহিমুল হক কিসলু বলেন, জেলা সদরে একটি স্মৃতিসৌধ নেই, ফলে স্বাধীনতা দিবসে ও বিজয় দিবসে আমরা চাইলেও শ্রদ্ধা নিবেদন করতে পারি না। অথচ আমরা সেই গর্বিত জাতি, আমাদের আছে স্বাধীনতা ও বিজয় দিবস।

জাসদ জেলা কমিটির সাধারণ সম্পাদক জাকির হোসেন লস্কর শেলী বলেন, মুক্তিযুদ্ধের স্বপক্ষের আমরা কেউ এ দায় এড়াতে পারি না। তবে তিনি এটি না হওয়ার জন্য প্রশাসনকেই বেশি দুষলেন।

সাতক্ষীরা প্রেসক্লাবের সভাপতি আবুল কালাম আজাদ বলেন, নব্বই দশকের শুরুতে তৎকালীন জেলা প্রশাসক আব্দুস সালাম স্মৃতিসৌধ নির্মাণের উদ্যোগ নেন, কিন্তু তিনি বদলি হওয়ার পর সে উদ্যোগও মাঠে মারা যায়।

১৯৭১ সালে হাসানুল ইসলামের বয়স ১৬ কিংবা ১৭ বছর। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ৭ মার্চের ঐতিহাসিক ভাষণ শুনে মহান মুক্তিযুদ্ধে অংশ নিয়েছিলেন তিনি। ১৯৭১ সালের ৭ ডিসেম্বর সাতক্ষীরা স্বাধীন হয়। কিন্তু প্রকৃতপক্ষে এ জেলাটি নাকি এখনও স্বাধীন হয়নি বলে  বলছিলেন রণাঙ্গনের বীর সেনানি হাসানুল ইসলাম।

তিনি বলেন, ‘সাতক্ষীরা স্বাধীন হলে শহীদদের স্মৃতিফলকে রাজাকার ও অমুক্তিযোদ্ধাদের নাম থাকবে কেন? ২০০৫ সালে সাতক্ষীরা জেলা প্রশাসকের কার্যালয় সংলগ্ন কালেক্টরেট চত্বরে জেলার শহীদ মুক্তিযোদ্ধাদের স্মরণে এ স্মৃতিফলক নির্মাণ করা হলেও আজও তা উদ্বোধন করা সম্ভব হয়নি।’ স্মৃতিচারণ করে হাসানুল ইসলাম বলেন, ‘১৯৭১ সালে যখন মুক্তিযুদ্ধ শুরু হয় তখন আমি মাত্র এসএসসি পাস করেছি। বঙ্গবন্ধুর ডাকে সাড়া দিয়ে এপ্রিল মাসের শেষের দিকে ভারত থেকে ট্রেনিং নিয়ে জুনে দেশে ফিরি। এরপর সাতক্ষীরার বালিয়াডাঙ্গায় সাব সেক্টর কমান্ডার মাহববুব উদ্দিনের (বীর বিক্রম) নেতৃত্বে যুদ্ধে অংশ নিয়েছিলাম। সেখানে পাকিস্তান হানাদার বাহিনীর সঙ্গে যুদ্ধে বেশ কয়েকজন গুলিবিদ্ধ হন। কিন্তু স্মৃতিফলকে তাদের নাম না রেখে অমুক্তিযোদ্ধা বা মানবতাবিরোধী অপারাধীদের নাম রাখা হয়েছে। যা আমাদের জন্য খুবই পীড়াদায়ক।’ তিনি আরও বলেন, ‘জেলা প্রশাসকের কার্যালয় ও জজকোর্ট চত্বরে ২০০৫ সালে নির্মাণ করা হয় মুক্তিযোদ্ধা স্মৃতিফলক। এ ফলকে মুক্তিযোদ্ধাদের নাম বসানোর জন্য একই বছরের ৯ জুন মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয় ৩১ জনের একটি নামে তালিকা সাতক্ষীরার গণপূর্ত বিভাগের নির্বাহী প্রকৌশলীর কাছে পাঠায়। সেই তালিকা অনুযায়ী নাম বসানো হয়। যেখানে রাজাকার ও অমুক্তিযোদ্ধাদের নাম স্থান পেয়েছে।’

গেরিলা মুক্তিযোদ্ধা কামরুজ্জামান বাবু ও ডেপুটি কমান্ডার শফিক আহমেদ বলেন, ‘এ ফলকে যাদের নাম বসানো হয় তাদের মধ্যে কলারোয়ার বাগডাঙ্গা গ্রামের গোলাম রহমান মুক্তিযুদ্ধের চেতনাবিরোধী ও রাজাকার ছিলেন। এছাড়ও আশাশুনির রফিকুল ইসলাম ও মোজাম্মেল হক এবং তালার সৈয়দ আবুল হোসেন দেদার বখত মুক্তিযুদ্ধে অংশ নেননি। ফলে স্মৃতিফলক নির্মাণের ১১ বছর পরও ক্ষোভ আর ঘৃণায় কোনও মুক্তিযোদ্ধা এখানে শ্রদ্ধা জানাতে আসেন না। আর যতদিন এটি সঠিকভাবে সংস্কার করা না হবে ততদিন সেখানে কোনও মুক্তিযোদ্ধা শ্রদ্ধা জানাতে যাবেন না। তবে ২০১২ সালে স্মৃতিফলক থেকে রাজকার ও অমুক্তিযোদ্ধাদের নাম মুছতে মুক্তিযোদ্ধারা সেখানে গিয়েছিলেন।’ গেরিলা মুক্তিযোদ্ধা কামরুজ্জামান বাবু বলেন, ‘স্মৃতিফলক মুক্তিযোদ্ধাদের প্রতি সম্মান ও বর্তমান প্রজন্মকে মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস জানানোর উদ্দেশে তৈরি করা। কিন্তু সাতক্ষীরার এ স্মৃতিফলকে মুক্তিযুদ্ধের চেতনাবিরোধী রাজাকার ও অমুক্তিযোদ্ধার নাম আছে। অথচ ১৭ জন শহীদ মুক্তিযোদ্ধার নাম স্মৃতিফলকে স্থান পায়নি। তাদের মধ্যে রয়েছেন- এ বি এম নাজমুল আবেদীন খোকন, মুনসুর আলী, আব্দুস সামাদ, আব্দুর রহমান, শাহাদাৎ হোসেন, আব্দুল ওহাব, গোলজার আলী, জাকারিয়া, নূর মোহাম্মদ, সোহরাব হোসেন, আবু দাউদ বিশ্বাস, নূল ইসলাম কারিগর, সুবেদার ইলিয়াস খান, আবুল কালাম আজাদ, ইঞ্জিনিয়ার আবুল কালাম আজাদ, মো. মোজাম্মেল হক ও মো. ইউনুস আলী।’

১২ লাখ ৪৬ হাজার ৭শ’ টাকা ব্যয়ে ২০০৫ সালের মে মাসে এ ফলকের নির্মাণ কাজ শুরু করে গণপূর্ত বিভাগ। একই বছরের ডিসেম্বেরে কাজ শেষ হলেও সেটি এখনও উদ্বোধন করা হয়নি। ফলে স্মৃতিফলকটির দেখভাল না করায় নষ্ট হয়ে যাচ্ছে। স্মৃতিফলকে নাম সংশোধনীর জন্য অনেক আন্দোলন ও স্মারকলিপি দেওয়া হলেও কোনও কাজে আসেনি। ডেপুটি কমান্ডার শফিক আহমেদ বলেন, ‘স্মৃতিফলকে রাজাকার ও অমুক্তিযোদ্ধাদের নাম রাখা স্থান পাওয়া মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য খুবই কষ্টের। এখন সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের কাছে দাবি স্মৃতিফলক থেকে রাজাকার ও অমুক্তিযোদ্ধাদের নাম বাদ দিয়ে সেখানে প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধাদের নাম যুক্ত করা হোক।’

এ বিষয়ে সাতক্ষীরা জেলা প্রশাসক আবুল কাশেম মো. মহিউদ্দিন বলেন, ‘বিষয়টি খুবই স্পর্শকাতর। স্মৃতিফলকে নাম থাকা কয়েকজনকে রাজাকার দাবি করা হলেও তাদের কাছে মুক্তিযোদ্ধা সনদ রয়েছে বলে জানতে পেরেছি। তাই যতক্ষণ পর্যন্ত তাদের মুক্তিযোদ্ধা সনদ বাতিল না হচ্ছে ততক্ষণ আমরা তাদের নাম মুছে ফেলতে পারি না। তবে বিষয়টি অবহিত করে মন্ত্রণালয়ে চিঠি পাঠানো হয়েছে। কিন্তু আজও আমরা চিঠির জবাব পাইনি। সরকার বিষয়টি মীমাংসা না করলে এখানে আমাদের কিছু করার থাকে না।’

তিনি আরো বলেন, আগের জেলা প্রশাসক ২০১৫ বছরের জুলাই মাসে ঢাকায় অনুষ্ঠিত জেলা প্রশাসক সম্মেলনে বিষয়টি তুলে ধরেন এবং আমার সময়ে চিঠির মাধ্যমে মন্ত্রণালয়ে জানিয়েছি। সেই প্রেক্ষিতে একটি সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে। সিদ্ধান্ত অনুযায়ী সাতক্ষীরা সদর হাসপাতালের সামনে মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতিস্তম্ভ তৈরি করা হবে। যেটি সাতক্ষীরা শহরকে সৌন্দর্য বর্ধনেও ভূমিকা রাখবে বলে আশাবাদ ব্যক্ত করেন তিনি।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.