পদ্মা নদীতে জেগে ওঠা চর জুড়ে ফলছে সোনার ফসল

স্বপন কুমার কুন্ডু, ঈশ্বরদী (পাবনা): ঈশ্বরদীর পদ্মা তীরবর্তী গ্রাম ও নদীতে জেগে ওঠা বিস্তীর্ণ চর জুড়ে কৃষকরা এখন সোনার ফসল ফলাচ্ছেন। পদ্মার ধূ ধূ বালুচর এক সময় পতিত জমি হিসেবে পরে থাকতো। এখন সেখানে বছর জুড়েই  নানা ফল ও ফসলের সমারোহ। পদ্মা নদী তীরবর্তী লক্ষ্মীকুন্ডা ইউনিয়নের কামালপুর, দাদাপুর, চরকুড়লিয়া, শান্তিনগর, ডিগ্রীর চর, চর মাদিয়া, বাটিকামারা, রাজারসাম, জয়েনপুর, সাঁড়া ইউনিয়নের সাহেবনগর চর, মোল্লা পাড়া ও বিল বামনী, পাকশী ইউনিয়নের চর রূপকণিকা, চর রূপপুর ও সাহাপুর ইউনিয়নের চর গড়গড়ি, চর কুড়লিয়া ও মালপাড়াসহ ১৫টি গ্রাম ও চরের জমি চাষাবাদ করে কৃষকরা এখন অর্থনৈতিকভাবে স্বাবলম্বী হয়ে উঠেছে। অথচ চরের জমি নিয়ে এক সময় রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষে প্রায় প্রতি বছরই খুন-জখমের ঘটনা ঘটতো। বিগত সাত বছর ধরে পরিবেশ শান্ত থাকায় কৃষকরা মনের আনন্দে হাসি মুখে ফসল ফলাচ্ছেন।

হর্ডিঞ্জ ব্রিজের নিচে সুবিশাল চর এখন চাষাবাদের জন্য তৈরি হচ্ছে।

সরেজমিন ঘুরে জানা গেছে, লক্ষীকুন্ডার কামালপুর, দাদাপুর, চরকুড়–লিয়া, শান্তিনগর ও ডিগ্রী চরের  জমি দখল নিয়ে দীর্ঘ পাঁচ দশকের বেশি সময় ধরে থেকে একাধিক পক্ষের মধ্যে দ্বন্দ্ব-সংঘাত চলে আসছিল। জমি দখল-বেদখল নিয়ে কয়েক দফা রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষ হয়। সর্বশেষ ২০০৯ সালে কামালপুর চরের জমিতে মশুর তোলা নিয়ে দুই পক্ষের মধ্যে সংঘঠিত সংঘর্ষে ৬ জনের প্রাণহানি ঘটে। এরপর চরের জমি নিয়ে লক্ষীকুন্ডায় আর কোন সংঘর্ষ  বাঁধেনি। এলাকাবাসী জানান, দ্বন্দ্ব-বিবাদ ভুলে এখন তারা কৃষি আবাদের দিকে ঝুঁকেছেন।

চরের জমি বন্দোবস্ত নিয়ে প্রান্তিক কৃষকেরা সেই জমিতে লাউ, চালকুমড়া,  মিষ্টি কুমড়া, শসা, ঝিঙে, করল্লা, পেঁপে, গাজর, ওল কপি, ফুলকপি, বাঁধাকপি, চিচিঙ্গা, ঢেঁড়স, ধনিয়া পাতাসহ বিভিন্ন শাকসবজি, আখ, মশুর, খেসারি, ছোলা, গমসহ নানা ফসল এবং পেয়ারা, লিচু,কলা ও বরইসহ বিভিন্ন ফলের বাগান ও খামার গড়ে তুলেছেন।
উৎপাদিত ফল ও ফসল বিক্রি করে প্রান্তিক কৃষকেরা অর্থনৈতিকভাবে এখন স্বাবলম্বী। এলাকার সহস্রাধিক কৃষক এই আবাদের সাথে জড়িত।  চরের এই বিশাল জমিতে মাঠ জুড়ে চোখে পড়ে শুধু সবজি আর ফসল। নানা রং ও স্বাদের সবজি এবং ফসল সোনার মত দামি কৃষকের কাছে। চর কুরুলিয়ার কৃষক সের আলী  প্রমানিক জানান, চরের এই জমিতে এখন সোনা ফলছে। তারা এখন মারামারি বিভেদ ভুলে চাষাবাদে মনযোগ দিয়েছেন। আফজাল মোল্লা জানান, চরের জমিতে চাষ করে তিনি এখন অভাব দূর করে স্বচ্ছল হয়ে উঠেছেন। তার ছয় বিঘা বর্গা নেওয়া জমিতে  ২০১৬ সালে প্রচুর সবজির আবাদ হয়েছে।

সাহাপুর ইউনিয়ন পরিষদের মেম্বার রুহুল আমিন জানান, চরের মানুষ কৃষিতে বিপ্লব ঘটিয়েছে। ফল-ফসলে চরের জমি ভরপুর। কৃষি ফসলকে কেন্দ্র করে এখানে কয়েকটি পাইকারী সবজি বিক্রয় হাট গড়ে উঠেছে। কিন্তু সবজি আবাদে অভাবনীয় সাফল্য অর্জিত হলেও ন্যায্য মূল্য না পাওয়ায় কৃষকরা হতাশ। সাহাপুর ইউপি চেয়ারম্যান মতলেবুর রহমান মিনহাজ জানান, সাহাপুর ইউনিয়ন কৃষিতে সমৃদ্ধ। এই ইউনিয়নের চরাঞ্চলে ব্যাপক সবজির আবাদ হচ্ছে। সবজি আবাদ করে কৃষকরা এখন শুধু স্বাবলম্বীই নয় অনেকে ধনী হয়ে উঠেছেন।
সবচেয়ে বেশি চরের জমি রয়েছে লক্ষ্মীকুন্ডা ইউনিয়নে। ইউনিয়নের ভূমি অফিস সূত্রে জানা যায়, লক্ষীকুন্ডায় নদী ভাঙনে জেগে উঠা চরের জমি রয়েছে ৬১২৮.১০ হাজার একর। এর মধ্যে এ বছর আবাদযোগ্য ১০৪৪.২৭ একর জমিতে চাষাবাদ হচ্ছে। নদীর জেগে উঠা জমির মালিকরা চাষাবাদের জন্য প্রান্তিক কৃষকদের বাৎসরিকভাবে বন্দোবস্ত দিয়েছেন।

ঈশ্বরদী উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা রওশন জামাল জুয়েল জানান, চরাঞ্চলের কৃষি ফসল ঈশ্বরদীর কৃষি অর্থনীতিতে ব্যাপক প্রভাব ফেলেছে। কৃষকদের আর্থ-সামাজিক উন্নয়নে  গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছে। চরের পলি মাটি হওয়ায় ফসলের রোগ বালাই কম হয় এবং সার ও কীটনাশক কম দিতে হয়। ফলনও হয় খুব ভাল। উৎপাদিত ফসলের জন্য যদি একটি সুষ্ঠু বাজার ব্যবস্থা গড়ে তোলা যেত তাহলে কৃষকরা ন্যায্য মূল্য পেয়ে অনেক বেশি লাভবান হতো। বাজার ব্যবস্থার বিষয়টি গুরুত্ব সহকারে দেখা উচিত বলে তিনি জানিয়েছেন।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.