পারিবারিক সহিংসতা নারীর অগ্রগতিতে বড় বাধা: মেহের আফরোজ

দেশের খবর রিপোর্ট: নারীর অগ্রগতিতে পারিবারিক সহিংসতাকে বড় বাধা উল্লেখ করে মহিলা ও শিশু বিষয়ক প্রতিমন্ত্রী মেহের আফরোজ চুমকি বলেছেন, লিঙ্গভিত্তিক বৈষম্য ও এর সঙ্গে সম্পর্কিত আর্থ-সামাজিক অন্যান্য বিষয়গুলোকে আরো গুরুত্ব দিয়ে মোকাবেলা করতে হবে। নারীর ক্ষমতায়নের জায়গাগুলো শক্তিশালী করতে পারলে নির্ধারিত সময়ের মধ্যে বাংলাদেশ স্থায়িত্বশীল উন্নয়ন লক্ষ্যগুলো অর্জন করতে পারবে।

ইউএসএআইডি’র সহায়তায় বাস্তবায়িত মানবাধিকার সুরক্ষা কর্মসূচির (প্রোটেক্টিং হিউম্যান রাইটস-পিএইচআর) সমাপনী উপলক্ষে আয়োজিত এক অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথির বক্তৃতায় মন্ত্রী এসব কথা বলেন।

দেশের ছয়টি জেলার ১০২টি ইউনিয়নে ২০১১ সালে শুরু হওয়া ছয় বছরের এ কর্মসূচি বাস্তবায়ন করে প্ল্যান ইন্টারন্যাশনাল।

অনুষ্ঠানে বক্তৃতা করছেন মেহের আফরোজ চুমকি।

রাজধানীর একটি হোটেলে পিএইচআর কর্মসূচির প্রভাব, চ্যালেঞ্জ এবং পরবর্তী করণীয় নিয়ে আয়োজিত এ অনুষ্ঠানে বিশেষ অতিথি ছিলেন বাংলাদেশে নিযুক্ত মার্কিন রাষ্ট্রদূত মার্শা বার্নিকাট, ইউএসএআইডি বাংলাদেশ মিশনের পরিচালক য়ানিনা য়ারুজাস্কি , মহিলা ও শিশু বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের সচিব নাসিমা বেগম, জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের সদস্য নুরুন নাহার ওসমানী এবং প্ল্যান ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের ভারপ্রাপ্ত পরিচালক সৈয়দা আসমা কাকলী।

মহিলা ও শিশু বিষয়ক প্রতিমন্ত্রী মেহের আফরোজ চুমকি জানান, নারীর প্রতি সহিংসতা দূর করতে সরকার নানামুখি কর্মসূচি বাস্তবায়ন করছে। মন্ত্রণালয়ের গৃহীত বিনামূল্যের হেল্পলাইন, ওয়ান স্টপ ক্রাইসিস সেন্টার, ট্রমা কাউন্সেলিং ইত্যাদি ব্যবস্থাগুলো সহিংসতার শিকার নারীদের জীবনে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখছে। এসব ব্যবস্থা আরো সম্প্রসারণ করা হবে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা নারীর প্রতি সহিংসতা ও বৈষম্য নির্মূলে বদ্ধপরিকর জানিয়ে মন্ত্রী বলেন, ২০৪১ সালের মধ্যে এগুলোর নির্মূল ঘটবে। নারী উন্নয়নের ক্ষেত্রে উন্নয়ন সংস্থাগুলো যেসব বিষয় সামনে নিয়ে আসছে, সরকারও সেগুলোকে অগ্রাধিকার দিয়ে কার্যক্রম গ্রহণ করছে।

মন্ত্রী আরো বলেন, নারীর ক্ষমতায়নে বাংলাদেশ একটি মডেল হিসেবে বিবেচিত হলেও নারীর প্রতি সহিংসতার মতো বিষয়গুলো এখনো ঘটে চলছে। বাল্যবিয়ে, শিক্ষায় অনগ্রসরতা ইত্যাদিসহ এর পেছনে রয়েছে নানা আর্থ-সামাজিক কারণ। আমাদেরকে এসব কারণগুলো নির্দেশ করতে হবে। ২০১০ সালে পারিবারিক সহিংসতা নিরোধে আইন প্রণয়ন হয়েছে এবং আইনের বাস্তবায়ন চলছে। সব ধরনের সহিংসতা প্রতিরোধে সরকার সকল প্রকারের চেষ্টা অব্যাহত থাকবে বলে জানান মন্ত্রী।

অনুষ্ঠানে বক্তৃতা করছেন মার্শা বার্নিকাট।

নারীর প্রতি সহিংসতাকে বৈশ্বিক মহামারি অভিহিত করে মার্কিন রাষ্ট্রদূত মার্শা বার্নিকাট বলেন, জরিপে দেখা গেছে যে, বিশ্বে প্রতি তিনজনে একজন নারী তার জীবনে শারীরিক লাঞ্ছনার শিকার হন। প্রতি পাঁচজন নারীর একজন নারী ধর্ষণের বা ধর্ষণচেষ্টার শিকার হন। প্রতিবছর সারা বিশ্বে দেড় কোটি মেয়ের ১৮ বছর পূর্ণ হবার আগেই বিয়ে হয়ে যায়। এ ধরনের প্রবণতা সামাজিক প্রগতিকে পিছিয়ে দেয় বলে উল্লেখ করেন রাষ্ট্রদূত।

বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর তথ্য উল্লেখ করে রাষ্ট্রদূত জানান, ২০১১ সালে বাংলাদেশে বিবাহিত নারীদের মধ্যে সহিংসতার শিকারের হার ছিল ৮৭ শতাংশের বেশি। সবার যৌথ প্রচেষ্টায় ২০১৫ সালে এই হার ৮০ শতাংশে নেমে আসে। তবে এই হার এখনো আশঙ্কাজনক পর্যায়ে রয়েছে এবং এটা কমাতে আরো অনেক উদ্যোগ নিতে হবে।

নারী ও শিশুর উন্নয়নসহ আর্থ-সামাজিক ক্ষেত্রে বাংলাদেশের অগ্রগতির প্রশংসা করে বার্নিকাট বলেন, নারীরা যদি ঘরে-বাইরে শঙ্কাহীন জীবন পায় তাহলে বাংলাদেশের এই অগ্রগতি আরো অর্থবহ হবে।

পিএইচআর কর্মসূচির সঙ্গে সম্পৃক্ত সমাজকর্মী আর আইনজীবীদের কর্মসূচির দুটি গুরুত্বপূর্ণ অনুঘটক উল্লেখ করে ইউএসএআইডি পরিচালক য়ানিনা য়ারুজাস্কি বলেন, মনো-সামাজিক বিষয় আর আইনি সহায়তা প্রদানের মধ্য দিয়ে এই দুটি দল পিএইচআর কর্মসূচিতে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রেখেছে। তিনি মনো-সামাজিক আর আধা-আইনি সেবাগুলো সম্প্রসারণের উপর গুরুত্ব দিয়ে বলেন, এ ধরনের ব্যবস্থাগুলোর সম্প্রসারণ বাংলাদেশকে লিঙ্গভিত্তিক সহিংসতা থেকে মুক্ত করবে।

অনুষ্ঠানের পিএইচআর কর্মসূচির প্রধান হেনরি আলড্রেফার কর্মসূচির কর্মকৌশল ও অর্জন উপস্থাপন করেন। তিনি জানান, এ কর্মসূচির সুদূরপ্রসারী লক্ষ্য ছিল পারিবারিক সহিংসতার উচ্চহার কমিয়ে আনা। কর্মসূচিতে বাল্যবিয়ে, যৌতুক আর যৌন হয়রানিকে বেশি গুরুত্ব দিয়ে কর্মকাণ্ড বাস্তবায়ন করা হয়। প্রধান কর্মকাণ্ড ছিল- সরকারি-বেসরকারি সংস্থার সঙ্গে অধিপরামর্শ, দক্ষতা উন্নয়ন, আইনি সহায়তা, ভুক্তভোগীদের সেবা প্রদান আর সচেতনতা সৃষ্টি।

তিনি আরো জানান, প্রকল্প এলাকায় দেড় হাজারের বেশি শিশুকে বাল্যবিয়ের হাত থেকে বাঁচানো হয়েছে। সরকারি-বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের কর্মী ও স্থানীয় পর্যায়ের ৪২ হাজার মানুষকে নির্বাচিত বিষয়ে প্রশিক্ষণ দিয়েছে পিএইচআর কর্মসূচি।

কর্মসূচি প্রধান আরো জানান,  কর্মএলাকায় সহিংসতার শিকার নারীদের আইনি বা আধা-আইনি ব্যবস্থায় অভিযোগ দায়েরের হার ৫০০ শতাংশ বেড়েছে। কর্মসূচিটি সহিংসতার শিকার নারীদের ৭০ কোটির বেশি টাকা খোরপোষ বা ক্ষতিপূরণ হিসেবে আদায় করতে সহায়তা করেছে। এছাড়া সরাসরি ২৬ লাখ মানুষের মধ্যে সচেতনতামূলক বার্তা পৌঁছানো হয়।

অনুষ্ঠানে কর্মসূচির সঙ্গে যুক্ত সরকারি কর্মকর্তা, সামাজিক সুরক্ষা দলের সদস্য, গ্রামপুলিশ, জনপ্রতিনিধি, আইনজীবী ও ভুক্তভোগীরা তাদের অভিজ্ঞতা উপস্থাপন করেন। বাংলাদেশে জাতীয় মহিলা আইনজীবী সমিতির (বিএনডাব্লিউএলএ) নির্বাহী পরিচালক অ্যাডভোকেট সালমা আলী অনুষ্ঠানে সমাপনী বক্তব্য রাখেন।

বিএনডাব্লিউএলএ ও ১১টি স্থানীয় উন্নয়ন সংস্থার সঙ্গে অংশীদারিত্বের ভিত্তিতে কর্মসূচিটি বাস্তবায়িত হয়।

অনুষ্ঠানের অতিথিরা সহযোগী সংস্থার প্রধানদের হাতে বিশেষ সম্মাননা স্মারক তুলে দেন।

Save

Save

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.